স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহীর বাঘা উপজেলা দলিল লেখক সমিতির জমজমাট নির্বাচন হতো। শেষ ২০১৭ সালে সালেও এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে এই কমিটি করা হচ্ছে খুদে বার্তায়। আর কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কে হবেন তা ঠিক করে দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউএনও) দুটি পদের নাম পাঠিয়ে দেন। ইউএনও তখন উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে নতুন সভাপতি-সম্পাদক ঘোষণা করেন।
বাঘা দলিল লেখক সমিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আওয়ামী লীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে ৩০ জনের মতো।
নিবন্ধিত কোন সংগঠন না হলেও ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত দলিল লেখক সমিতির সভাপতি-সম্পাদক মনোনয়ন দিতেন সাধারণ দলিল লেখকেরা। সর্বসম্মতিক্রমে সে কমিটি দুইবছর সমিতি চালাতো। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সভাপতি-সম্পাদক নির্বাচন করারও নজির আছে। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম খুদে বার্তায় কমিটি গড়েন, খুদে বার্তায় ভাঙেন।
দলিল লেখকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২১ সালের দিকে হঠাৎ দলিল লেখকের লাইসেন্স পেয়ে যান উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি শাহিনুর রহমান পিন্টু। অথচ তিনি দলিল লিখতে জানেন না। লাইসেন্স পাওয়ার ছয়মাসের মাথায় নির্বাচন ছাড়াই পিন্টু হঠাৎ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হয়ে যান। আর সভাপতি হন আবদুল লতিফ মিয়া নামের এক দলিল লেখক।
এক বছর পর আবার নতুন কমিটি আসে। নির্বাচন ছাড়াই এবার সভাপতি হন উপজেলা সৈনিক লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মিল্টন। আর সাধারণ সম্পাদক হন পাকুড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শামিউল আলম নয়ন। এরপর সম্প্রতি আবার মিল্টনকে সরিয়ে পিন্টুকে সভাপতি করা হয়। তারপর থেকে মিল্টন আর দলিল লিখতে যাননি।
মিল্টন জানান, প্রায় ১৬ মাস আগে একদিন বাঘার তৎকালীন ইউএনও শারমিন আখতার তাকে এবং শামিউল আলম নয়নকে ফোন করে ডাকেন। তারা কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ দলিল লেখককে সঙ্গে নিয়ে ইউএনওর কার্যালয়ে যান। তখন ইউএনও শারমিন আখতার তাদের জানান, তার কাছে একটি এসএমএস এসেছে। সে অনুযায়ী এখন থেকে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি মিল্টন। আর সাধারণ সম্পাদক নয়ন। ওই এসএমএসটি পাঠিয়েছিলেন সংসদ সদস্য ও তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
মিল্টন আরও জানান, যেদিন ইউএনও ওই এসএমএসের কথা জানান সেদিনই তারা গিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাদের এই কমিটির দুই বছর দায়িত্ব পালনের কথা ছিল। কিন্তু ১৬ মাস পরই এই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে এসএমএসের মাধ্যমে। নতুন সভাপতিও দেওয়া হয়েছে এসএমএসে।
মিল্টন বলেন, উপজেলা নির্বাচনের পর গত ৯ জুন সাব-রেজিস্ট্রার আমাকে আর সাধারণ সম্পাদক নয়নকে ডেকে পাঠান। আমরা যাওয়ার পর সাব-রেজিস্ট্রার বলেন যে, একটি এসএমএস এসেছে। আমাকে ‘স্যাক’ করা হয়েছে। এখন থেকে নতুন সভাপতি শাহিনুর রহমান পিন্টু। এ কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমি নতুন সভাপতি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। দলিল লেখক সমিতির কমিটি গঠন কিংবা ভেঙে দেওয়ার জন্য মিল্টন একটি এসএমএসের কথা বললেও সেটি কে দিয়েছেন তার নাম উচ্চারণ করেননি। এসএমএস কে দিয়েছেন তা বুঝে নিতে বলেন তিনি।
বাঘার বর্তমান ইউএনও তরিকুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, দলিল লেখক সমিতির নতুন সভাপতি-সম্পাদকের নাম জানিয়ে গত ৯ জুন তাকে এসএমএস দিয়েছেন সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। তিনি এই এসএমএসটি সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ইউএনও বলেন, আমার কাছে তিনি এসএমএস পাঠিয়েছিলেন। আমার কাছে অনেকেই অনেক কিছু পাঠাতে পারেন।
এভাবে এসএমএস কমিটি দেওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলমকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। প্রশ্ন জানিয়ে হোয়াটস্যাপে বার্তা দেওয়া হলে তিনি সেটি দেখেছেন। কিন্তু কোন জবাব দেননি। সেই জন্যে এ বিষয়ে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সমিতিতে টাকার খেলা : দলিল লেখকেরা জানান, সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের কাছে লাখ লাখ টাকা জমা হয়। তারা জানান, সপ্তাহে দুইদিন দলিল লেখার কাজ চলে। কেনাবেচার সময় কোন জমির দাম এক লাখ টাকা হলে সরকারি খরচ বাদে সমিতি ক্রেতার কাছ থেকে ৪ হাজার টাকা আদায় করে। এভাবে প্রতি এক লাখের জন্য ৪ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। যে লেখক দলিল লেখেন তিনি এই টাকার ২৫ শতাংশ পারিশ্রমিক পান। ২৫ শতাংশ জমা রাখা হয় সমিতির ব্যাংক হিসাবে। আর বাকি ৫০ শতাংশ টাকা প্রতি সপ্তাহে সমিতির সব সদস্যদের মাঝে ভাগাভাগি হয়। এই টাকার একটি অংশ ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাসহ বেশ কয়েকটি খাতে দেওয়া হয়। এ জন্যই ২০১৯ সাল থেকে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি-সম্পাদক নিজের অনুসারী লোককেই রাখেন সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম।
দলিল লেখক সমিতির সভাপতি শাহিনুর রহমান পিন্টু স্বীকার করেন, সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম তাকে সমিতির সভাপতি করেছেন। জমির মূল্য হিসেবে প্রতি লাখের জন্য ৪ হাজার টাকা নেওয়ার কথাও স্বীকার করেন তিনি। তবে তিনি দাবি করেন, সারাদেশেই এভাবে টাকা নেওয়া হয়। বরং, তারা যে টাকা নেন তা দেশের অন্যান্য উপজেলার চেয়ে কম।
জানা গেছে, ৫ জুন বাঘা উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে শাহরিয়ার আলমের পছন্দের প্রার্থী রোকনুজ্জামান রিন্টু পরাজিত হন। আর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন পৌর মেয়র আক্কাস আলীর অনুসারী লায়েব উদ্দিন লাভলু। এ নির্বাচনে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি মিল্টনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই ৯ জুন এসএমএস দিয়ে তাকে সভাপতির পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়।
পরদিন ১০ জুন দলিল লেখক সমিতির নতুন কমিটির সভাপতি পিন্টু ও সাধারণ সম্পাদক নয়ন দায়িত্ব নিতে যান। সেদিন সাধারণ দলিল লেখকদের একাংশ এই এসএমএস কমিটির বিরোধীতা করেন। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর প্রতিবাদে কমিটিবিরোধী দলিল লেখকেরা ২০ জুন মানবন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেন। এই মানববন্ধনে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন লাভলু ও পৌর মেয়র আক্কাস আলী। তারা দলিল লেখকদের বাড়তি টাকা আদায় বন্ধের দাবি জানান।
পরে ২২ জুন দলিল লেখক সমিতির দৌরাত্ম বন্ধের দাবিতে বাঘা উপজেলার সচেতন নাগরিকের ব্যানারে লাভলু ও আক্কাসের সমর্থকেরা বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেন। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে একই দিন বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাস আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মানববন্ধনের ডাক দেয় বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগ। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে দুপক্ষের কর্মী-সমর্থকেরা উপজেলা চত্বরে জড়ো হলে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে দুপক্ষের অর্ধতাধিক নেতাকর্মী আহত হন।
গুরুত্বর জখম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চারদিন পর তিনি মারা যান। আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল মেয়র আক্কাসের বিরুদ্ধে আয়োজন করা মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাস আলীও আছেন। পুলিশ তার ৫ দিন রিমান্ডের আবেদন করেছে।
আপনার মতামত লিখুন :