ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা রোধে সাবধানতা ও সবার সহায়তা কাম্য


editor প্রকাশের সময় : মার্চ ২৬, ২০২৫, ৪:৩২ অপরাহ্ণ /
ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা রোধে সাবধানতা ও সবার সহায়তা কাম্য

আসন্ন ঈদুল ফিতর সামনে রেখে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে লোকজন। এক হিসাব মতে এবারের ঈদে প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ রাজধানী ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করবে। দেশের অন্যান্য শহর থেকেও প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি লোক যাতায়াত করবে বলে জানা যায়। মোট যাত্রীর ৭৫ শতাংশ সড়কপথে, ১৭ শতাংশ নৌপথে এবং ৮ শতাংশ রেলপথে যাতায়াত করবে। ঈদযাত্রায় রেলপথ তুলনামূলক ব্যয়সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। রেলযাত্রায় মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি। ঈদযাত্রায় যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনা করে সর্বোচ্চসংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য রেল কর্তৃপক্ষও যথারীতি সচেষ্ট। এজন্য ২৪ মার্চ হতে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন অতিরিক্ত পাঁচ জোড়া ট্রেন পরিচালনা করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এসময় নিয়মিত চলাচলকারী আন্ত:নগর সকল ট্রেনের সাপ্তাহিক বিরতি বাতিল করা হয়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে অতিরিক্ত যাত্রী চাহিদা পূরণের জন্য ২৮টি মিটারগেজ ও ১৬টি ব্রডগেজ কোচসহ মোট ৪৪টি কোচ বিভিন্ন যাত্রীবাহী সার্ভিসে যুক্ত করা হয়েছে। এতৎসত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা থেকে প্রতিদিন মাত্র ৩৫ হাজারের কিছু বেশি যাত্রী পরিবহণ করতে পারবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। নৌপথ নিরাপদ হলেও এর যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা খুব সীমিত। ঈদযাত্রায় মোট যাত্রীর সিংহভাগই সড়কপথে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করবে।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারো সড়কপথে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে যাত্রী পরিবহনের জন্য সরকারের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাড়তি ট্র্যাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ভাঙাচোরা রাস্তা ইতোমধ্যে যথাসম্ভব মেরামত করা হয়েছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ সিসি ক্যামেরার দ্বারা সার্ভিলেন্সের আওতায় আনা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন স্থানে সাইন সিগন্যালসমূহ যথাযথভাবে কার্যকর করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সম্ভাব্য যানজট এড়াতে টোল প্লাজাসমূহের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, লেভেল ক্রসিং ও রোড ক্রসিংয়ে নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা। এসব সতর্কতা প্রতিবছরই গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, যানজট, যাত্রী ভোগান্তি, যাত্রী হয়রানি প্রতিবছরই আগের বছরের তুলনায় বাড়তে থাকে। এই প্রবণতা রোধ করা জরুরি ও আমাদের অবশ্য কর্তব্য। যাত্রীদের নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও হয়রানিমুক্ত ঈদযাত্রা নিশ্চিত করা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মূল দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে কেউ অবহেলা বা গাফিলতি প্রদর্শন করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি হলেও দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত একেবারেই নগণ্য। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এজন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য হলেও দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
ঈদযাত্রা আরম্ভ হলে সড়কে ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর বাস এমনকি দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহনেও থেমে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এসব বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। তাই ঈদ যাত্রায় অন্তত ১৫/২০ দিন পূর্বে থেকেই সড়কে ফিটনেসবিহীন ও রুট পারমিটবিহীন গাড়ি চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঈদযাত্রায় অধিকসংখ্যক বাস অধিক ট্রিপ পরিচালনা করায় চালক ও সাপোর্টিং স্টাফদের অতিরিক্ত খাটুনি খাটতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে একজন চালক টানা দুই/তিন দিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন, মাঝে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় পাচ্ছেন না। এতে তার শারীরিক ও মানসিক অবসাদ তার কাজের প্রতি অমনোযোগিতা সৃষ্টি করে। এতে সাপোর্টিং স্টাফদের দ্বারা তেমন ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলেও চালকদের অমনোযোগীতার কারণে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই প্রত্যেকটি দূরপাল্লার বাসে একজন বিকল্প চালক রাখা এবং চালকদের প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সুযোগ দেয়া উচিত। এ ব্যাপারে পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক সমিতির কার্যকর ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।
ঈদযাত্রায় যাত্রী চাহিদা অধিক হওয়ায় পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের অন্যতম টার্গেট থাকে যে একই গাড়ি দিয়ে অধিক সংখ্যক ট্রিপ পরিচালনা করে অধিক পরিমাণ অর্থ উপর্জান করা। এজন্য চালকদের উপর ওভারস্পিডে গাড়ি চালানোর জন্য একটা বাড়তি চাপ থাকে। তাছাড়া সাধারণত চালকদের নিয়মিত/মাসিক ভিত্তিতে বেতন ভাতা না দিয়ে মালিক পক্ষ তাদেরকে ট্রিপভিত্তিক মজুরি দিয়ে থাকে। ফলে চালকগণ বাড়তি রোজগারের আশায় বাড়তি ট্রিপের পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান। এ ধরনের মনোভাব পরিহার করে যাত্রীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া এবং অধিক মুনাফার লোভে যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওভার স্পিডে গাড়ি চালানো বা চালাতে বাধ্য করা পরিহার করতে হবে। চালকদেরকে ট্রিপভিত্তিক মজুরি না দিয়ে নিয়মিত/মাসিক বেতন-ভাতার ভিত্তিতে নিয়োগের সংস্কৃতি চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইন প্রয়োগ আরো কঠোর হতে হবে। অনুমোদিত গতিসীমা অতিক্রম করলে সংশ্লিষ্ট চালক ও মারিক পক্ষকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতিবছর ঈদযাত্রার প্রাক্কালে রাস্তার মেরামত কাজ আরম্ভ করা হয়। এসময় একদিকে রাস্তায় যানবাহনের চাপ থাকে বেশি অন্যদিকে মেরামত কাজের জন্য রাস্তায় যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় যা তীব্র যানজট সৃষ্টি করে। এজন্য রাস্তার প্রয়োজনীয় মেরামত ও সংস্কার কাজ ঈদযাত্রা আরম্ভ হওয়ার আগেই শেষ করা উচিত। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও কর্তৃপক্ষকে আরো আন্তরিক ও সতর্ক হওয়া উচিত।

রাস্তায় যাত্রী উঠানোর জন্য যত্রতত্র পার্কিং এবং রাস্তা বন্ধ করে বা রাস্তার আড়াআড়ি গাড়ি রেখে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। পেছনের গাড়ি যেন সামনের গাড়িকে ওভারটেক করে গিয়ে সামনের স্টেশন থেকে যাত্রী না নিতে পারে এজন্য ইচ্ছাকৃত এই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। বিশেষ করে স্বল্প দূরত্বের লোকাল বাস এই অপকর্মটি বেশি করে থাকে যার ফলে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। এই অন্যায় প্রতিযোগিতা ও অবৈধ পার্কিং প্রতিরোধে চালক, কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।
ঈদ যাত্রায় চালক, মালিকপক্ষ ও সরকার যথাযথ তৎপর থাকা সত্ত্বেও যাত্রী সাধারণ সচেতন না হলে যানজট ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা কারো একার পক্ষে সম্ভব হবে না। এজন্য যাত্রীদেরও সচেতন, সহনশীল ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। এজন্য প্রথমেই ঈদযাত্রার একটি উন্নত পরিকল্পনা করতে হবে। যেহেতু এবার অফিস আদালতে ঈদের ছুটি আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই স্কুল কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি দেওয়া হয়েছে। তাই সম্ভব হলে ছেলে মেয়ে শিশুসহ কর্মজীবী সদস্য বাদে পরিবারের অন্যদের ঈদযাত্রা শুরু হওয়ার পূর্বেই গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। কর্মজীবী সদস্যরা পরে ধীরে সুস্থে যাত্রা করলে ভোগান্তির মাত্রা কমে আসবে অনেকাংশে। যাত্রাকালে ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে বের হতে হবে। রাস্তায় কোন স্থানে তড়িঘড়ি হুড়োহুড়ি করে যানবাহনে উঠা থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করে গাড়িতে উঠতে গিয়ে অনেকে ছোটখাটো দুর্ঘটনার শিকার হন। অনেকক্ষেত্রে ছিনতাই বা চুরির শিকার হতে পারেন। কিংবা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ বস্তু হারিয়ে যেতে পারে। তাই যথাসম্ভব ধীরে সুস্থে মাথা ঠান্ডা রেখে যাত্রা করতে হবে।
রাস্তায় সম্ভাব্য যানজটের কথা মাথায় রেখে সে মোতাবেক প্রস্তুতি রাখতে হবে। সামান্য কিছু শুকনা খাবার ও পানি সাথে রাখ ভালো। রাস্তায় বা যানবাহনে অপরিচিত কারো দেওয়া বা অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু কিনে খাওয়া উচিত নয়। এতে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। যাত্রায় প্রাক্কালে মোবাইল ফোনে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স ও চার্জ রাখতে হবে যেন রাস্তায় যেকোনো বিপদ আপদ হলে আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতজনদের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করা যায়। জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা ভালো। খুব বেশি পরিমাণ নগদ টাকা বা ব্যাংকের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড নিয়ে ভ্রমণে বের না হওয়াই ভালো। অনেক ক্ষেত্রে ছিনতাইকারী চক্র অপহরণের মাধ্যমে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন করতে পারে। সর্বোপরি চলন্ত অবস্থায় চালকের সাথে কথা বলা বা গাড়ি দ্রুত চালানোর জন্য তাকে চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। মনে রাখবেন ঈদ উপলক্ষ্যে অতিরিক্ত খাটুনির জন্য তারা ইতোমধ্যেই অবসাদগ্রস্ত তাকে স্বস্তিতে ঠান্ডা মাথায় গাড়ি চালাতে দিন। এসব বিষয় আমরা সবাই কম বেশি জানি কিন্তু বাস্তবে মনে রাখার বা সে অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করার চেষ্টা করিনা। আমাদের মনে রাখা উচিত যে এসব ছোটো খাটো সতর্কতা আমাদেরকে বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। নিজে সচেতন থাকুন অন্যের বিরক্তির কারণ হবেন না। নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও হয়রানিমুক্ত ঈদযাত্রা সবার কাম্য ।

লেখক : রেজাউল করিম সিদ্দিকী
সিনিয়র তথ্য অফিসার, রেলপথ মন্ত্রণালয়
পিআইডি ফিচার