পঞ্চাশ পেরোনো সামেনা বেগম এক ঝলমলে সকালে শুকনো পরিষ্কার টাইলসের ওপর দড়ি থেকে উড়ে পড়া শুকনো কাপড়ের মতো দলা পাকিয়ে পড়ে গেলেন। আর উঠতে পারছেন না। ছেলেমেয়েরা কেউ বাসায় নেই। কাকে ডাকবেন তাকে টেনে তোলার জন্য?
তীব্র ব্যথায় ছটফট করছেন। দুর্দান্ত প্রতাপশালী স্বামী, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার আব্দুস সামাদের কানে গেল স্ত্রীর আহাজারি। তিনি ভাবলেন, বাতের ব্যথা কি আজকাল দিনের বেলাতেই অচল করে দিল তার স্ত্রীকে? নিজে সারাজীবন ব্যায়ামের অভ্যেস মেনে চলেছেন চাকরির স্বভাব অনুযায়ী। অবসরের পর শুয়ে বসে দিন কাটলেও তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা তার নেই। অথচ ডায়াবেটিস, বাতের ব্যথা, একটু ঝাল খেলেই অম্বল জাতীয় নানা সমস্যা সামেনা বেগমকে বিরক্ত করে। তিনি চান, এসব অজুহাত ছেড়ে ফেলে ভদ্রমহিলা কর্মঠ থাকবেন, সব সময় সচল থাকার চেষ্টা করবেন। তাহলেই তো নানা সমস্যাকে এড়িয়ে সুস্থ থাকতে পারবেন, গাদা গাদা ঔষুধ খেতে হবে না। সেজন্যই স্বামী হিসেবে তিনি চেষ্টা করেন সব সময় স্ত্রীকে ব্যস্ত রাখতে। ঘন ঘন চা পেতে চান, পিঠা-পুলি খুব পছন্দের, প্রতি বেলার রান্নায় চান সেরা রাঁধুনির সিগনেচার ডিশ।
সামেনা বেগম নরম মানুষ। সারা জীবন বড়লির চাকরি করা স্বামীকে খুব একটা কাছে পাননি, সন্তানদের মানুষ করতেই বেলা গেছে। পড়ন্ত সময়ে তিনিও চান স্বামীর পছন্দের খাবার রান্না করতে। সারা জীবন তাকে ব্যস্ত থাকতেই তো দেখেছে সবাই। এখনো সেলাই করেন, খালি চোখে সুইয়ের ছিদ্রতে সুতা ভরতে পারেন। কত কী রান্না করেন, কিন্তু নিজে খান পরিমিত। মিষ্টি-মসলা এড়িয়ে চলেছেন সব সময়। এরপরও কেনো ডায়াবেটিস, কেনো বাতের ব্যথা, কেনো অম্বল তিনি জানেন না। এই যে এখন মাটিতে পড়ে আছেন, উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেই তীব্র ব্যথায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, এর কারণও তিনি জানেন না। একটু আগে চা চেয়েছিলেন আব্দুস সামাদ। চা বানাতেই সামেনা বেগম রান্নাঘরের দিকে এগুচ্ছিলেন। পারলেন না।
আব্দুস সামাদ খুব বিরক্ত। পুলিশি মেজাজে মনে হচ্ছে নিজস্ব নারী তার কাজে ফাঁকি দেয়ার বাহানা খুঁজতে মাটিতে বসে পড়েছেন। তিনি চায়ের তেষ্টাকেই গুরুত্বের জায়গায় রাখলেন। সামেনা বেগম মাটিতে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে রান্না ঘরে গিয়ে চা বানিয়ে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। আত্মতুষ্টিখানা গরম চায়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন আব্দুস সামাদ। রাতে ছেলেমেয়েদের বকুনি খেয়ে বিরক্ত ভাবটা আবার ফিরে এল। মেয়েটা ডাক্তারি পড়ছে, ছেলেটাও বিজ্ঞান নিয়েছে কলেজে। দাঁত ভেঙে যাওয়ার মত নানা শব্দ কুলকুচি করে ওরা যা বোঝাতে চাইল, তা হচ্ছে ওদের মায়ের ডান পায়ের উরুর হাড় কোনো এক পয়েন্টে ভেঙে গেছে। জানাল, পুরুষদের তুলনায় নারীদের হাড় ভেঙে যাওয়ার সমস্যা বেশি। অর্থাৎ, নারী পুরুষের তুলনায় বেশি ভঙুর।
পুরুষের শক্তি-সামর্থ্যরে বড়াই আরেকবার করতে চেয়েছিলেন। পারলেন না। ছেলেমেয়েরা রেগে যেতে পারে। সময়ের প্রয়োজনে তিনিও সামেনা বেগমকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন। ফেসবুকে মাঝে মাঝে ‘নারী কিসে আটকায়’ প্রশ্ন তুলে নারী চরিত্রের বিশ্লেষণে মেতে উঠতে দেখেন, কখনো কখনো নিজেও তাল দেন সেসবে। এই প্রথম ভঙুর নারীদের যন্ত্রণাকাতর মুখগুলোর ভিড়ে সামেনা বেগমের মুখ দেখে অনুভব করলেন জ¦লজ্যান্ত এক প্রশ্ন চাবুকের মতো পিঠে পড়ছে। নারী কিসে ভাঙে? নারীকে ভাঙে অস্টিওপোরোসিস নামের একটি সমস্যা, যা মূলত নারীর শরীরে হরমোনের পরিবর্তন, হাড়ের গঠন ছোটো হওয়া এবং মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার ফলে হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়ার কারণে ঘটে। পুরুষ নারীর মতো নাটকীয় হরমোনের পরিবর্তন টের পান না। পুরুষের হাড়ের ক্ষয় হয় ধীরে। পুরুষের তুলনায় নারীর হাড় ছোট আর পাতলা। অর্থাৎ শুরু থেকেই নারীর হাড়ের ভর থাকে কম। বয়স বাড়তে বাড়তে হাড় ক্ষয় হওয়ার ঝুঁকি যায় বেড়ে।
আব্দুস সামাদ সামেনা বেগমের ভাগ্য স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই খারাপ করে রেখেছেন বলে দায় এড়াতে চাইলেও পারলেন না। তিনি জেনে গেছেন, জীবনভর ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার কম খাওয়ার ফলে নারী অস্টিওপোরোসিসে বেশি আক্রান্ত হন। এশিয়া অঞ্চলের নারীরাই নাকি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। বাংলাদেশে প্রতি ৩ জন বয়সি নারীর ১ জন এই ঝুঁকি বহন করছেন। সেখানে প্রতি ৫ জন বয়সি পুরুষের ১ জন হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকিতে থাকেন।
পাতলা, ছোটো হাড়যুক্ত দেহ নারীর। শারীরিক পরিশ্রমও তারা কম করেন। দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগ ও কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও হাড়ক্ষয় হয়। আরও আছে, নারী জীবনভর কম ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন ডি গ্রহণ করেন।
আব্দুস সামাদ সামেনা বেগমকে দেখেছেন সন্তানদের সামনে দুধভর্তি গ্রাস ধরে চোখ পাকিয়ে বলতে, খাও! স্বামী ভালোবাসেন বলে ঘন দুধের পায়েস রেঁধে বাটিভরে স্বামীর সামনে দিয়ে মিষ্টি হাসতেন সামেনা বেগম। সন্তানরা এবং স্বামী কখনোই গুরুত্বের সাথে দেখেননি, মা এবং স্ত্রী দুধ খাচ্ছেন কি না। মাছ-মাংস-ডিমের কথা আর না-ই বা বলি। সকলের খাওয়া শেষে খেতে বসা নারী কতটুকু পুষ্টি তার শরীরে দিতে পারেন? শৈশব-কৈশোরে নারী পরিবার থেকে পুষ্টিকর খাবার কতটুকু পান? ১৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সি শতকরা ৪০ ভাগ নারীর হাড় কম ঘনত্বের। যে নারী ক্ষমতায়িত হন, উপার্জন করেন, তিনিও সচেতন নন নিজে পুষ্টিকর খাবার খেতে, পরিবারের সবাইকে খাইয়ে চলেন ঠিকই। নারী মহৎ হতে ভালোবাসেন, নিজেকে ভালোবাসতে অভ্যস্ত তিনি নন। পুরুষেরও সচেতনতার অভাব আছে। আর নিম্ন আয়ের মানুষদের সামর্থ্যই বা কতটুকু যে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি, ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার নিজে খাবেন, পরিবারের সবাইকে খাওয়াবেন!
হাড় ক্ষয় রোগের ভয়টা বেশি, কারণ আক্রান্ত না হওয়ার আগে কেউ বুঝতে পারেন না তিনি আক্রান্ত হবেন কি না। সামেনা বেগম যেমন উরুর হাড় ভাঙার পর বুঝলেন। বয়স ৪৫ পার হলেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। অর্থোপেডিক সোসাইটির গবেষণায় বলা হয়েছে, ৪৬ থেকে ৭০ বছর বয়সে অস্টিওপোরোসিস সাধারণ সমস্যা। সঠিক চিকিৎসার অভাবে শতকরা ৫০ ভাগ রোগী ৬ মাসের মধ্যে মারা যান। তবে আগেভাগে ঝুঁকি নির্ণয় করতে পারলে সঠিক চিকিৎসা, ঠিকমতো খাবার গ্রহণ এবং নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ধূমপান হাড় ক্ষয়ের অন্যতম কারণ, এই তথ্য জেনে আব্দুস সামাদ নিজেকে নিয়ে ভাবনায় পড়লেন। নিজের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে সময় থাকতেই। কেননা সামেনা বেগমের মতো তিনি যদি মাটিতে বসে যান! তখন সামেনা বেগম তার দেখভাল করবেন তিনি জানেন। তিনি যেমন এই এখন সামেনা বেগমের দেখভাল করবেন। সেদিন স্বামীগিরি ফলানোর জন্য সুযোগ পেলেই সামেনা বেগমের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন, সেটাও ভেবেছেন। মাটিতে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে রান্নাঘরে গিয়ে সেদিনও সামেনা বেগম ফার্স্ট ক্লাস চা বানিয়ে খাইয়েছেন তাকে।
নারী ভাঙে শুধু হাড়ের ক্ষয়ে নয়, বরং অবহেলা, অসম্পূর্ণ পুষ্টি, দায়িত্বের ভার, আর চিরচেনা আত্মত্যাগের চাপে। সামেনা বেগমের মতো অসংখ্য নারী আছেন, যারা সবার যত্ন নিতে গিয়ে নিজের যত্ন নিতে ভুলে যান। অথচ সুস্থতা শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি পরিবারের, সমাজের এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সময় এসেছে বদলানোর। নারীদের শুধু পরিবারের জন্য নয়, নিজেদের জন্যও সচেতন হতে হবে। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত শরীরচর্চা, আর হাড়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা—এসব শুধু বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন। আর পুরুষদেরও বোঝা উচিত, নারীর যত্ন শুধু তার নিজের দায়িত্ব নয় বরং পরিবারের সবারই সমান দায়িত্ব।
নাসরীন মুস্তাফা
পিআইডি ফিচার
আপনার মতামত লিখুন :