স্টাফ রিপোর্টার: সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি ও সারদেশে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ করছেন আন্দোলনকারীরা। ভাঙচুর চালিয়েছেন ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবাসিক হলে। এসময় কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুনও দেয়া হয়। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতির কোনো ক্ষতি করেননি তাঁরা। আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ছাত্রলীগের অবস্থান জানতে পেরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সেখানে যায়। একপর্যায়ে তারা বঙ্গবন্ধু হলের হলের গেট ও জানালা ভাঙচুর করেন। এছাড়াও ছাত্রলীগ সভাপতি মোস্তাফিজ রহমান বাবুর রুম থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও একটি দেশিয় পিস্তল পাওয়া গেছে। এছাড়াও সেখান থেকে বেশ কিছু দেশি অস্ত্রও উদ্ধার করেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনকারি শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক হয়ে প্রধান ফটক ভেঙে প্যারিস রোডে যায়। সেখান থেকে মিছিলটি বিভিন্ন আবাসিক হলের সামনে দিয়ে প্রদক্ষিণ করে। এর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কয়েকটি হলের গেটে তালা দিয়েছেন। বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে শিক্ষার্থীরা প্যারিস রোডে উপাচার্য ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না’, ‘লড়াই হবে সেখানে, বাঁধা আসবে যেখানে’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। বিক্ষোভ চলাকালে শিক্ষার্থীদের হাতে লাঠিসোঁটা ও বাঁশ দেখা গেছে।
এদিকে, সকাল সাড়ে ১১টা থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বরে অবস্থান নেন। এছাড়া তাঁরা মোটরবাইক নিয়ে বিভিন্ন আবাসিক হলের সামনে দিয়ে মহড়া দেন। দল বেঁধে বেশ কয়েকজনকে কয়েকটি হলের আশপাশে অবস্থান নিতে দেখা দিয়ে গেছে। সকাল থেকেই পরিস্থিতি থমথমে ছিল। তবে শিক্ষার্থীদের মিছিল শুরু হলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীকে অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে, বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে ক্যাম্পাস ছেড়ে যান বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব ও তাঁর নেতাকর্মীরা।
মঙ্গলবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হলে আগুন দেয় কোটা সংস্কার ইস্যুতে আন্দোলনকারীদের একাংশ। এসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কক্ষে ভাঙচুর করা হয় এবং থেকে ১৮ থেকে ১৯টি মটরসাইকেল ও সাইকেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন আন্দোলনকারীরা। এ ঘটনায় ভেতরে আটকা পড়েন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের দুইটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন দেওয়া বেশিরভাগ বাইকগুলো ছিল ছাত্রলীগ নেতাদের। তবে সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও বাইক-বাইসাইকেল ছিল বলে জানা গেছে। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর বিকেল সোয়া ৪টার দিকে আটকে পড়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই হল থেকে বেরিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যান।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে উপ-সহকারী পরিচালক আখতার হামিদ খান জানান, ৩টা ৪০ মিনিটে রাবি বঙ্গবন্ধু হলে আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়া হয়। পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের দুইটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে ১৮-১৯টি মোটরসাইকেল, বেশকিছু বাইসাইকেল ও আসবাবপত্র আগুনে পুড়ে যায়। তবে কেউ হতাহত হননি। ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পরে জানানো হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, ক্যাম্পাসে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। তবে বিশৃঙ্খলা রোধে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। বঙ্গবন্ধু হলে আগুন দেওয়ার বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, কোটা আন্দোলনকারীরা বঙ্গবন্ধু হলের নিচতলায় আগুন দিয়েছেন। এরই মধ্যে আগুন নেভানো হয়েছে। রাবি প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফিরলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মূল ফটকের তালা ভেঙে ক্যাম্পাসে প্রবেশ:
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার প্রতিবাদে লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনে নামেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদনপুর বাজারে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের তালা ভেঙে ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করেন তারা। এদিকে ছাত্রীরাও হলের তালা ভেঙে মিছিলে যোগ দিয়েছেন। বিকেল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে অবস্থান করেছেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগ নেতাদের বেশ কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর ও মোটরসাইকেল আগুন দেয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আসাবুল হক বলেন, আমরা ক্যাম্পাস শান্ত রাখতে চেয়েছিলাম। আমরা নানাভাবে নানা সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আজকে তারা তাদের প্রোগ্রাম করবে আমরা কোনো বাধা দেব না, ছাত্রলীগও কোনো বাধা দেবে না। পুলিশ, প্রক্টর, শিক্ষক সবাইকে আমরা এই অনুরোধ রেখেছি। তারপরও বঙ্গবন্ধু হলে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
আন্দোলনকারীদের দখলে রাবি ক্যাম্পাস:
কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক দফা দাবিসহ সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাস দখলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এদিকে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া খেয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব। অপরদিকে বিক্ষোভ চলাকালে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুসহ অন্য ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদেরও ক্যাম্পাসে দেখা মেলেনি। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব মাদারবখ্স হলের সামনে কয়েকজন সহযোগী নিয়ে অবস্থান করছিলেন। এসময় শহীদ কামারুজ্জামান হলের পাশ দিয়ে বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ মাদারবখ্স হলের দিকে এগিয়ে আসেন। বিক্ষোভকারীদের দেখেই দ্রুত মোটরসাইকেলে উঠে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।
এদিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে অবস্থান, বঙ্গবন্ধু হলে ভাঙচুর, মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করলেও কোথাও ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে জানতে তাঁর মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। পরে কল দিচ্ছি।’ কিন্তু তিনি আর ফোন দেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, ‘আমরা প্রক্টরিয়াল বডি ও পুলিশবাহিনী সবাইকে রেখেছি। তারপরও একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এটা কারা ঘটিয়েছে আমরা জানি না। অবশ্যই এর তদন্ত হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :