ভূমিসেবায় প্রযুক্তির ছোঁয়া


editor প্রকাশের সময় : মে ৩১, ২০২৫, ৩:২৭ অপরাহ্ণ /
ভূমিসেবায় প্রযুক্তির ছোঁয়া

মানুষের জীবন ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। এমনকি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নও নির্ভর করে ভূমির উপযুক্ত ব্যবহারের ওপর। ভূমি মানুষের জন্মগত অধিকার হলেও ভূমির ওপর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাপনা কখনই স্বচ্ছ ছিল না। অন্যদিকে ভূমির ব্যবস্থাপনা সুদীর্ঘকাল ধরে এতদঞ্চলের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মুখ্য ভিত্তি হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে এবং এর ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। ভূমি ব্যবস্থাপনার ইতিহাস মূলত আদিযুগ, হিন্দু আমল, মুসলিম আমল, ব্রিটিশ আমল এবং বর্তমান আমল (পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল) পর্যন্ত বিস্তৃত।
বাংলাদেশের ভূমি সেবা দ্রুতই ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নাগরিকের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে ইতোমধ্যেই চালু হয়েছে ওয়েবভিত্তিক ভূমিসেবা সিস্টেম ২.১। হয়রানি, ভোগান্তি, দুর্নীতি ইত্যাদি বন্ধে ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম আশীর্বাদ স্বরূপ। পর্যায়ক্রমে ভূমি ব্যবস্থাপনার সবকিছুই নিয়ে আসা হচ্ছে অনলাইনে। ফলে ঘরে বসেই অনলাইনে জমির নিবন্ধন, নামজারি,ম্যাপ, খাজনা, খাজনাসহ সব ধরনের কাজ করা যাচ্ছে। এতে সময়, শ্রম এবং খরচ—সবই সাশ্রয় হচ্ছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনা মূলত ভূমির ক্রয়-বিক্রয়, সঠিক জরিপ, জমা-খারিজ-নামজারি, খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর আদায়, খাস, পরিত্যক্ত জমি লিজ প্রদান, জলমহাল হাট-বাজারের ইজারা প্রদান, উত্তরাধিকার সূত্রে জমি হস্তান্তর, খায়-খালাসি বন্ধক, জমির বিপরীতে ঋণ গ্রহণ ইত্যাদি। এখন ঘরে বসেই ভূমি সংক্রান্ত আবেদন, নথি যাচাইসহ নানান সেবা পাওয়া যাচ্ছে www.land.gov.bd ওয়েব পোর্টালে । তবে প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে সাইবার হামলার ঝুঁকিও বেড়েছে বহুগুণ, যা সরকারি তথ্য ও নাগরিকের ব্যক্তিগত ডাটার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিকিউরিটি, অডিট ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল (এসএকিউ) শাখা হতে সম্প্রতি একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, যেখানে ভূমিসেবা সিস্টেম ব্যবহারকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ভূমিসেবা সিস্টেম সরকারি ক্লাউড সার্ভারে হোস্ট করা এবং পাবলিক ইন্টারনেটের মাধ্যমে নাগরিকেরা সেবা গ্রহণ করেন, তাই অননুমোদিত প্রবেশ বা হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি সর্বদা বিদ্যমান। ব্যবহারকারীর কম্পিউটার বা ডিভাইস যদি সঠিকভাবে সুরক্ষিত না থাকে, অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার না থাকে, কিংবা ব্রাউজার নিরাপদভাবে ব্যবহার করা না হয়, তবে তথ্য চুরি (কিংবা ক্ষতি) হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। ব্যবহারকারীর অসাবধানতায় নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য যেমন বেহাত হতে পারে ঠিক তেমনিভাবে সরকারি তথ্য তথা তথ্যভান্ডারের (ডেটা-সেন্টার) ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ভূমিসেবা পোর্টালটি ব্যবহারের জন্য একটি আলাদা ব্রাউজার ব্যবহার করতে। যেমন, যদি Google Chrome ভূমিসেবার জন্য ব্যবহার করা হয়, তবে ব্যক্তিগত কাজে Mozilla Firefox বা Microsoft Edge ব্যবহার করতে হবে। এতে ব্যক্তিগত ও সরকারি কাজের তথ্য মিশ্রিত হবে না, ফলে সাইবার ঝুঁকি অনেকাংশে কম আসবে। যদি আলাদা ব্রাউজার ব্যবহার করা সম্ভব না হয়, তবে ইনকগনিটো (Incognito) বা প্রাইভেট (Private) মোড ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে ব্রাউজিং হিস্ট্রি, কুকিজ বা অন্যান্য তথ্য ডিভাইসে সংরক্ষিত হবে না, ফলে ঝুঁকি কমে যাবে।
এছাড়া ল্যান্ড গেটওয়েতে প্রবেশের জন্য পাসওয়ার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনসাধারণকে আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অনেকেই সহজে মনে রাখার জন্য নিজের বা পরিবারের নাম, জন্মতারিখ, মোবাইল নম্বর দিয়ে পাসওয়ার্ড তৈরি করেন, যা সাইবার অপরাধীদের কাছে সহজ টার্গেট হয়ে যায়। এজন্য নির্দেশনায় বলা হয়েছে: নিজের বা পরিবারের কোনো তথ্য পাসওয়ার্ডে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একই পাসওয়ার্ড একাধিক সাইট বা অ্যাপে ব্যবহার করা যাবে না। ব্রাউজারে পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ না করা। কখনো পাসওয়ার্ড অন্যের সঙ্গে শেয়ার না করা এবং অরক্ষিত কোনো জায়গায় লিখে না রাখা। ৪৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে পাসওয়ার্ড পরিবর্তনের অভ্যাস গড়ে তোলার বিষয়ে নজর দিতে বলা হয়েছে।
সকল সরকারি ও ব্যক্তিগত অনলাইন অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এই নির্দেশনায়, যেমন- অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার নিয়মিত আপডেট রাখা; পেনড্রাইভ বা পোর্টেবল ডিভাইস ব্যবহারের আগে ভাইরাস স্ক্যান করা; গুরুত্বপূর্ণ ফাইল সেকেন্ডারি ড্রাইভে সংরক্ষণ করা; সন্দেহজনক লিঙ্ক, যেমন অজানা শর্ট লিঙ্কে ক্লিক না করা; অপ্রত্যাশিত/সন্দেহজনক ই-মেইল খোলা বা উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকা; অপ্রয়োজনীয় ওয়েবসাইট সাইট ব্রাউজ না করা; আকস্মিক বিজ্ঞাপন বা পপআপে ক্লিক না করা; অজানা Add-ons বা Browser Extensions ইনস্টল করা এড়িয়ে চলা; কাজ শেষে সিস্টেম থেকে লগআউট করা এবং অফিস ত্যাগের আগে ডিভাইস বন্ধ করা; যেকোনো সমস্যায় পড়লে বা ডিভাইস অস্বাভাবিক আচরণ করলে বিষয়টি না-এড়িয়ে অতি দ্রুত সাপোর্ট টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
জনস্বার্থে এই নির্দেশনাগুলো মানা বাধ্যতামূলক। কারণ একটি নিরাপদ ভূমিসেবা সিস্টেম কেবল প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা নয়, ব্যক্তিগত সচেতনতার ওপরও নির্ভরশীল। ডিজিটাইজ বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরাপদ ভূমিসেবা নিশ্চিত করতে নাগরিকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কেননা একটি মাত্র অসাবধান ক্লিক বা অবহেলায় সরকারি সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। প্রযুক্তির এই যুগে ব্যক্তিগত সাইবার নিরাপত্তায় নাগরিকের সর্বপ্রথম দায়িত্ব। প্রযুক্তির সুফল গ্রহণের পাশাপাশি এর ঝুঁকিও মাথায় রেখে সচেতনতার সঙ্গে ভূমিসেবা ব্যবহার করতে অনুরোধ করা হয়েছে।

লেখক: মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন
সিনিয়র তথ্য অফিসার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, ভূমি মন্ত্রণালয়
পিআইডি ফিচার