নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হলে এগিয়ে যাবে দেশ


editor প্রকাশের সময় : এপ্রিল ২২, ২০২৫, ২:৩৮ অপরাহ্ণ /
নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হলে এগিয়ে যাবে দেশ

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশের সাহসী নারী শিক্ষার্থীদের সম্প্রতি পুরস্কৃত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক ম্যাডেলিন অলব্রাইট অনারারি গ্রুপ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন সাহসী এই নারীরা। বাংলাদেশের নারীদের এ আন্দোলনের সূচনা ছিল চাকরিতে কোটা নামক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যা পরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। মার্কিন পুরস্কারের মাধ্যমে নিজ দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আন্দোলনে ভূমিকা রাখা সাহসী নারীদের প্রকৃতভাবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা সহজেই অনুমেয়।

কেবল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেই নয়, জাতীয় জীবনের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে দেশের নারীদের অংশগ্রহণ ও অসামান্য অবদান রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও সাহসিকতার জন্য নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পেয়েছেন। বাংলাদেশের নারীদের সঠিকভাবে সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে তাঁরাও দেশ গঠনে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হবেন। এর উদাহরণ তো সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থানে নারীদের সাহসিকতাপূর্ণ অংশগ্রহণেই রয়েছে। যেখানে স্কুলছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারীরা রাস্তায় নেমে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।

তারপরেও এদেশে নারীরা নানা মাত্রায় বৈষম্যের শিকার। বৈষম্যের সাথে নির্যাতন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নির্যাতন দিয়েই শুরু হয় নারীর প্রতি বৈষম্য। দেশে নারী নির্যাতন এবং বিশেষ করে ধর্ষণের মতো অপরাধ দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ৯৯। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি অংশ নারী। কিন্তু এই নারীরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি নারীর প্রতি নির্যাতনের প্রধান ধরনের মধ্যে ধর্ষণ সবার শীর্ষে রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৭ হাজার ৪৭৯টি, যার মানে প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। একই সময়ে দেশে ৫৯ হাজার ৯৬০টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রাকে প্রকাশ করে না, বরং সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরে। ২০২৪ সালে যৌতুকের দাবিতে ৩৬ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন, যা সমাজ ও দেশের জন্য অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয়।

দেশের নারীরা স্বাধীনতার পূর্ণতা উপভোগ করতে পারে না সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বকীয় অধিকারের অভাবে। সামাজিক সাংস্কৃতিক বাধার কারণে এখনো নারীদের সিদ্ধান্ত পুরুষরাই নেয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এজেন্সির নীতি নির্ধারণী কাঠামোতে – যেমন গভর্নিং বোর্ড, নির্বাহী কমিটি, স্থানীয় প্রকল্প প্রণয়ন, সরকার কাঠামো এবং বাস্তবায়ন ও পরীক্ষণ কমিটিতে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত কম । এছাড়াও তথ্যের অধিকার ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নারীরা বৈষম্যের শিকার। একটি জাতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য কখনই সুফল বয়ে আনতে পারে না। নারী-পুরুষ সমভাবে কাজ করলেই দিন বদলানো সম্ভব, একটি জাতির উন্নয়নও সম্ভব।

যেকোনো জাতিসত্তার উন্নয়নে প্রথমেই যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো শিক্ষা। বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও নারীরা পিছিয়ে আছে । স্কুলে ভর্তি এবং শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়ার হার ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে বেশি। তাছাড়া উপবৃত্তি প্রদানের আবশ্যক শর্তগুলো না মানায় নারী শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পাচ্ছে । সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে বৈষম্য ।
আবার, স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে নারীরা যথেষ্ট বৈষম্যের শিকার । বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির তথ্য অনুযায়ী, মায়েদের নিরাপদ প্রসবপূর্ব সেবার জন্য সরকারের ব্যয় বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় শতকরা ৪৯ ভাগ এবং প্রসব পরবর্তী সেবার জন্য মাত্র শতকরা ১৮ ভাগ । তাছাড়া ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের কারণে অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও অসুস্থ হলে সময় মত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার অভাবে গ্রাম্য নারীরা অনেক সময় মৃত্যুবরণ করেন।

কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি । পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে বৈষম্য, কাজ বণ্টনে বৈষম্য ও তথ্যের অভাবে নারী উদ্যোক্তারা পিছিয়ে থাকার প্রবণতা দৃশ্যমান । এক সমীক্ষায় দেখা গেছে নারীরা পুরুষদের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি সময় পারিশ্রমিকসহ এবং বিনা পারিশ্রমিকে গ্রামে মোট শ্রমের ৫৫ শতাংশ ও শহরে মোট শ্রমের ৫০ শতাংশ  শ্রম দান করে। কিন্তু অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নারীরা চিরকাল অবহেলিত ।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার গত  ১১ এপ্রিল এক মতবিনিময় সভায় বলেন, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ভাগে অসমতা সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এটা দূর করতে হবে। কারণ, লড়াই-সংগ্রামে নারী-পুরুষ সমানে সমানে অংশগ্রহণ করছে। তিনি আরও বলেন, সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার না থাকায় যে পরিবারে শুধু মেয়ে সন্তান রয়েছে, তাঁরা বেশি অসহায়ত্বে পড়েন। এই অসমতা বৈষম্যের বড়ো হাতিয়ার। এমনকি সন্তানের অভিভাবকত্বের জন্য নারীকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। গণঅভ্যুত্থানে নারী-পুরুষ পরস্পরকে আন্দোলনকারী ভেবেছেন উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, তাঁরা নিজেদের নারী বা পুরুষ হিসেবে ভাবেননি। সমাজে সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে ছাত্র-জনতা। সেই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য না করে মানুষ হিসেবে সমান অধিকার দিতে হবে নারীকে। তাঁদের মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি কোনো কোনো গোষ্ঠী ডিজিটাল মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব, ভুল তথ্য ও মিথ্যা ছড়িয়ে নারীবিরোধী ঘৃণ্য প্রচারণা চালিয়ে এবং অসহিষ্ণুতা উসকে দিয়ে সমাজে সম্প্রীতি ও সহনশীলতার পরিবেশ বিনষ্ট করছে; নারীবিদ্বেষকে উসকে দিচ্ছে এবং বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অনলাইনে নারীকে হেনস্তাকারী নারীবিরোধী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করা না গেলে ডিজিটাল খাতের অগ্রগতি নারীর জন্য কোনোই ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে না।

বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহার বিশ্ববাসীকে পরস্পরের কাছাকাছি এনে দিয়েছে। এর ফলে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। তবে সব শ্রেণির মানুষের যেহেতু প্রযুক্তিতে অভিগম্যতা সমান নয়, তাই এ অগ্রগতির সুফল সব মানুষের কাছে সমানভাবে পৌঁছেনি। যেহেতু বিদ্যমান প্রযুক্তি নারীবান্ধব নয়, সেখানে অভিগম্যতা ও সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে নারীরা ব্যাপকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। জাতিসংঘের উইমেনস জেন্ডার স্ন্যাপশট প্রতিবেদন ২০২২ অনুযায়ী, অনলাইনভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৩৮ শতাংশ নারী। আমরা জানি, বাংলাদেশের সমাজ উন্নয়নে নারীরা পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক খাতের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তার মূলেও নারীর অবদান উল্লেখযোগ্য। বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণকালে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকার মূল কারণ গার্হস্থ্য, কৃষি, গার্মেন্টসসহ আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রে নারীর নিরলস শ্রম, যা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও তার লেখায় দেখিয়েছেন। অথচ একই সময়ে বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে নারীকে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে না তুলে অদক্ষতার অজুহাতে শ্রমবাজার থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অর্থ-সম্পদ না থাকার কারণে আধুনিক সরঞ্জাম ক্রয়ে অসমর্থতার কারণেও শ্রমবাজারের প্রতিযোগিতায় নারীরা পিছিয়ে পড়ছে।

বর্তমানে নারী-পুরুষের বৈষম্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। যদিও অগ্রগতির কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। এই পর্যায়ে পৌঁছাতে সর্বপ্রথম পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারে সন্তানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য বা বৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। সাইবার দুনিয়াসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ, রাস্তাঘাট, যানবাহন, কর্মস্থল, বিনোদনকেন্দ্র, পর্যটনকেন্দ্র সবকিছুই নারীবান্ধব করতে হবে। সব স্থানে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

বর্তমান বাংলাদেশে নারীরা যেমন রাজনীতির মাঠে কাজ করছে তেমনি তারা পিছিয়ে নেই কর্পোরেট চাকরি থেকে, ক্রিকেট খেলার মাঠ বা ফুটবল, বিচারকের আসন বা কৃষিকাজের মাঠ সর্বক্ষেত্রে নারীদের বিচরণ প্রশংসনীয়। কিন্তু এই প্রগতিশীল সময়েও নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে তাদেরকে প্রতিযোগী হিসেবে মনে করা হয়। আমরা আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের জায়গা থেকে আজও পিছিয়ে আছি। সমাজে নারী ও পুরুষ হাতে হাত মিলিয়ে সমানতালে চলতে শুরু করলে আমাদের সমাজ পরিবর্তন হবে এবং সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন আসবে।
নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা অনেক। তবে আমাদের সমাধানের উপায় খোঁজা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নৈতিকভাবে শক্তিশালী করা প্রয়োজন । প্রতিটি থানায় নারী নির্যাতন-সংক্রান্ত আলাদা ইউনিট গঠন করা যেতে পারে, যেখানে নারীরা সহজে তাদের অভিযোগ জানাতে পারবেন। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা ও আইনি কাঠামোর দুর্বলতা বিচার প্রার্থী নারীদের অনেকখানি ভোগায়। নারী নির্যাতনের মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত, যাতে ন্যায়বিচার দ্রুত নিশ্চিত করা যায়। বর্তমানে নারীদের জন্য আইনি সহায়তা ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও অনেক নারী এ সম্পর্কে অবগত নন। তাই এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো প্রয়োজন। পাশাপাশি নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত।

একই সাথে স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে নারী অধিকার ও আত্মরক্ষার কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। নারীরা কীভাবে আইনি সহায়তা পেতে পারেন, কোথায় অভিযোগ জানাতে পারেন-এসব তথ্য সহজলভ্য করা উচিত। ডিজিটাল নিরাপত্তা-ব্যবস্থা নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নারীদের জন্য এমন একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে তাঁরা যখনই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন, তখনই দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা পেতে পারেন। বর্তমানে সরকার নারী নিরাপত্তা ও সহায়তা বৃদ্ধির জন্য ‘নারী সহায়তা কেন্দ্র’ চালু করেছে, তবে এর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ ছাড়া, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেট বৃদ্ধি করে নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ, পুনর্বাসন এবং আইনি সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ আরও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে নারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় নারীরা যে খুব বেশি পিছিয়ে আছেন, বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। এসব নারী সাংবাদিকের অনেকেই রেডিও ও টেলিভিশনকেই তাঁদের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যানজটের খবর থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সহিংসতার খবর, স্টুডিওর আয়েশি পরিবেশ থেকে রোদে পুড়ে অথবা বৃষ্টিতে ভিজে সরাসরি সম্প্রচারে অংশ নেওয়া-এগুলোর কোনো কিছুতেই নারীরা পিছিয়ে নেই।

সম্প্রতি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ৪৩৩টি সুপারিশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ পেশ করেছে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীর জন্য ৩০০ সংরক্ষিত আসন, বিয়ে-তালাক, উত্তরাধিকারে সমান অধিকার দেওয়ার সুপারিশ, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা। নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা। শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা। সকল প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি দেওয়ার সুপারিশ। সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী–পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিত’ শিরোনামে প্রতিবেদনে নারী বিষয়ক কমিশন আরও সুপারিশ যেসব সুপারিশ করেছে তা হলো, নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা, ধর্ষণের শিকার হওয়া অন্য লিঙ্গের মানুষের বিচার ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিতে আইনে ধর্ষণ ধারায় সংস্কার আনা, নারীর প্রতি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও যথাযথ সংবেদনশীল আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি উল্লেখযোগ্য।

সর্বোপরি নারীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা অপরিহার্য, যেন তারা তাদের প্রাপ্য সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে  সুযোগের সমতা বুঝে পান । নারীরা নিরাপদ থাকলে, তারা সমাজ ও দেশের উন্নয়নে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত না করা গেলে জাতীয় উন্নয়ন  বাধাগ্রস্ত হবে। তাই এই সমস্যা সমাধানে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। তাহলেই নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হবে, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। মনে রাখা প্রয়োজন, একজন নারী যদি জিতে যায়, তাহলে আমার মা বা বোনের বিজয় হবে।

লেখক:  ম. জাভেদ ইকবাল
সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর
পিআইডি ফিচার