তথ্য সাক্ষরতা


editor প্রকাশের সময় : এপ্রিল ১৯, ২০২৫, ১২:১৬ অপরাহ্ণ /
তথ্য সাক্ষরতা

সাক্ষরতা হলো সমাজে কাজ করার জন্য, নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য এবং নিজের জ্ঞান ও সম্ভাবনা বিকাশের জন্য মুদ্রিত এবং লিখিত তথ্য ব্যবহার করার ক্ষমতা । অর্থাৎ সাক্ষরতা বলতে কোনোও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতার জ্ঞানকে বোঝায়। একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতা কাঠামোর মধ্যে ৩টি সাক্ষরতা দক্ষতা রয়েছে, এগুলো হল তথ্য সাক্ষরতা, মিডিয়া সাক্ষরতা এবং প্রযুক্তি সাক্ষরতা । তাই আমাদের প্রথমেই জানা দরকার Information literacy বা তথ্য সাক্ষরতা কি? তথ্য সাক্ষরতা হলো তথ্যের বিভিন্ন ফরমেট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে বের করা, মূল্যায়ন করা, সংগঠিত করা, ব্যবহার করা এবং যোগাযোগ করা ক্ষমতা অর্জন। বিশেষ করে সমস্যা সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্যটি খুঁজে বের করা, মূল্যায়ন করা এবং কার্যকরভাবে সেই তথ্যটি ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জনকে Information literacy বা তথ্য সাক্ষরতা বলে । তথ্য সাক্ষরতার পাঁচটি উপাদান রয়েছে । এগুলো হলোঃ তথ্যের উৎস সনাক্ত করা, খুঁজে বের করা, মূল্যায়ন করা, প্রয়োগ করা এবং স্বীকৃতি দেওয়া। তথ্য সাক্ষরতা একটি জীবনব্যাপী শেখার প্রক্রিয়া, যা স্কুল থেকে শুরু হয় এবং বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বিকশিত হয়। যদিও মানব জীবনে প্রতিটি দক্ষতাই গুরুত্বপূর্ণ, তারপরও বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রতিটি মানুষকে তথ্য সাক্ষর ব্যক্তি হওয়া অপরিহার্য। জীবন চলার সর্বক্ষেত্রে রয়েছে এর ব্যবহার। তাই সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের জন্য তথ্য সাক্ষরতা অপরিহার্য।
‘তথ্য সাক্ষরতা’ শব্দটি ১৯৭৪ সালে আমেরিকান নাগরিক পল জি. জুরকোস্কি প্রথম ব্যবহার করেন । তিনি সফ্টওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে জাতীয় গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান কমিশনের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদনে তথ্য শিক্ষিতদের দ্বারা শেখা “কৌশল এবং দক্ষতা” বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথম এ শব্দটি ব্যবহার করেন। জুরকোস্কির মতে, তথ্য সাক্ষরতায় বিশ্বাসী ব্যক্তি হলেন এমন কেউ যিনি কর্মক্ষেত্রে এবং তার দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা সমাধানে তথ্য সরঞ্জামের বিস্তৃত পরিসর এবং প্রাথমিক উৎস থেকে তথ্য খুঁজে ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জন করেছে। যিনি বিস্তৃত তথ্য ভান্ডার থেকে সঠিক তথ্যটি খুঁজে বের করে সমস্যার সমাধান করতে পারবেন তিনি হলেন ‘তথ্য শিক্ষিত’, আর যিনি ভান্ডার থেকে সঠিক তথ্যটি খুঁজে বের করতে পারবেন না এবং সমস্যার সমাধানও করতে পারবেন না তিনি হলেন ‘তথ্য নিরক্ষর’ । ১৯৭৬ সালে টেক্সাসের এএন্ডএম বিশ্ববিদ্যালয় লি বুর্চিনারের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে । সেই গবেষণাপত্রে ‘তথ্য সাক্ষরতার’ ধারণাটি আবারও গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয় । একই বছরে এএন্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি প্রবন্ধে , এমআর ওয়েন্স রাজনৈতিক তথ্য সাক্ষরতা এবং নাগরিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে ধারণাটি প্রয়োগ করে বলেছিলেন, “সকল মানুষ সমানভাবে তৈরি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তথ্য সম্পদের অধিকারী ভোটাররা তথ্য নিরক্ষর নাগরিকদের তুলনায় বেশি বুদ্ধিমান । নাগরিক দায়িত্ব পালন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তথ্য সম্পদের প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” ২০০৮ সালে ইউনেস্কোর সদর দপ্তর প্যারিসে ইউনেস্কো কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এক বৈঠকে MIL (Media and Information Literacy) এর সূচনা হয়। বিশেষজ্ঞরা MIL-কে একটি সমন্বিত ধারণা হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হন, যেখানে মিডিয়া সাক্ষরতা এবং তথ্য সাক্ষরতা এই দুটি প্রধান উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
তথ্য সাক্ষরতার মূল লক্ষ্য হলো জীবনের সকল স্তরের মানুষকে তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, পেশাগত এবং শিক্ষাগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কার্যকরভাবে তথ্য অনুসন্ধান, মূল্যায়ন, ব্যবহার এবং তৈরি করার দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায়িত করা । তথ্য সাক্ষরতার চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো হলো ডেটা পড়ার ক্ষমতা, প্রেক্ষাপট বোঝা, ডেটা তৈরি, অর্জন এবং পরিচালনা সহ ডেটা নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা। তথ্য সাক্ষরতার ৮টি দক্ষতা রয়েছে। একে ডিজিটাল সাক্ষরতার 8C বলে। এগুলো হলো: সাংস্কৃতিক (Cultural), যোগাযোগমূলক (Communication), জ্ঞানীয় (Cognitive), নাগরিক (Citizenship) , সহযোগিতামূলক (Constructive), সৃজনশীল (Creativity), আত্মবিশ্বাসী (Confidence), এবং সমালোচনামূলক ( Critical thinking) । প্রতিদিন আমরা ওয়েব এবং গণমাধ্যম প্রকাশিত বিভিন্ন অর্টিকেলের মাধ্যমে বৈচিত্র্যময় তথ্যের মুখোমুখি হই। অসংখ্য উৎস থেকে বিভিন্ন ফর্ম্যাটে এসব তথ্য আমাদের কাছে আসে। পক্ষপাতদুষ্ট, পুরানো, বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা উৎসের পাশাপাশি প্রামাণিক, বর্তমান এবং নির্ভরযোগ্য উৎসগুলো থেকেও তথ্য আসে। তথ্যের পছন্দের মধ্যেও তথ্যের মান ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়।সঠিক তথ্য জানার সুযোগ থাকা যেমন একজন মানুষের অধিকার তেমনি পক্ষপাতদুষ্ট, পুরানো, বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা তথ্য থেকে নিজেকে রক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে পাওয়ার সুযোগ মানুষের অধিকার। এজন্য বৈচিত্র্যময় বিশাল তথ্য ভান্ডার থেকে তথ্যের উৎস সনাক্ত করা, খুঁজে বের করা, মূল্যায়ন করা এবং প্রয়োগ করার কৌশল জানা জরুরি।
তথ্য সাক্ষরতার দক্ষতা ব্যক্তিগত, পেশাগত এবং শিক্ষাগত জীবনে সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে বিশেষ পরিস্থিতির মুখোমুখি কমবেশি সকলকেই সব সময়ে হতে হয়। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নানারকম তথ্য উপাত্তের প্রয়োজন হয়।বাস্তব জীবনেও আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই যেখানে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের নতুন তথ্য অনুসন্ধান করতে হয়। নাগরিক সমস্যা সমাধান , সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলিতে জনমত গঠনের মুখোমুখি হতে হয়।অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে সব সময়ই আমাদের মাথা ঘামাতে হয়। এ সবই দৈনন্দিন জীবনের অংশ । এগুলোকে বাদ দিয়ে আমরা চলতে পারবো না। তথ্য সাক্ষরতার দক্ষতা থাকলে খুব সহজেই এ সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যেহেতু তথ্য সাক্ষরতা জীবনব্যাপী শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান,তাই সব সময় নিজেকে এ বিষয়ে হালনাগাদ রাখতে হবে। তথ্য সাক্ষরতা জীবনব্যাপী শিক্ষার ভিত্তি তৈরি করে। এটি সকল শাখায়, সকল শিক্ষার পরিবেশে এবং সকল স্তরের শিক্ষার জন্য প্রয়োজন।
শিক্ষিত ব্যক্তিরা অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংস্কৃতি বুঝতে পারেন । তারা পড়া, লেখা এবং শোনার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনযাত্রার ধরণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মুখোমুখি হন এবং তারা বিভিন্ন পটভূমির সমবয়সিদের সাথে কার্যকরভাবে কাজ করতে এবং যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। কিন্তু অশিক্ষিত ব্যক্তিরা অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংস্কৃতি বুঝতে পারেন না। ঠিক একইভাবে তথ্য সাক্ষরতা ব্যক্তি কখন এবং কেন তথ্যের প্রয়োজন, কোথায় তা খুঁজতে হবে এবং কীভাবে এটিকে নৈতিকভাবে মূল্যায়ন, ব্যবহার ও যোগাযোগ করতে হবে তা জানে এবং সমস্যার ইতিবাচক সমাধান করতে পারে। কিন্তু তথ্য নিরক্ষর ব্যক্তি এটা করতে পারে না। তথ্য সাক্ষরতার চারটি প্রকার রয়েছে। এগুলো হলো: তথ্যপ্রযুক্তির সাবলীলতা, চিন্তাভাবনার ধরণ, সমস্যা সমাধান এবং যোগাযোগ। গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্য সাক্ষরতার সাতটি স্তম্ভ রয়েছে। এগুলো হলো :ডিজিটাল, ভিজ্যুয়াল এবং মিডিয়া সাক্ষরতা, একাডেমিক সাক্ষরতা, তথ্য পরিচালনা, তথ্য দক্ষতা, ডেটা কিউরেশন এবং ডেটা ব্যবস্থাপনা।
তথ্য সাক্ষরতার দক্ষতা শিক্ষার উন্নতি, অফিস ও ব্যবসায় কার্যকারিতা বৃদ্ধি, সামাজিক যোগাযোগের সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ভবিষ্যতের উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব পূরণ, গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি হ্রাস, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণ, ডিজিটাল বৈষম্য হ্রাস, অপতথ্য ও গুজব প্রতিরোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমানে তথ্য সাক্ষরতা আমাদের জীবনে একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটি আমাদের শিক্ষা, ব্যবসা, স্বাস্থ্য, সামাজিক জীবন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নতুন করে রূপ দিয়েছে। তথ্য সাক্ষরতা আমাদের জীবনযাত্রাকে আরও সহজ এবং কার্যকরী করতে পারে, তবে এর অপব্যবহার থেকেও সচেতন থাকাতে হবে।

ইমদাদ ইসলাম
পিআইডি ফিচার