অনলাইন ডেস্ক : ২০১৭ সালে বর্বর অত্যাচার ও নির্মম গণহত্যা চালিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে দেশটির সেনাবাহিনী। ওই সময় জীবন বাঁচাতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। যারা এখন কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তবে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরতে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
মোহাম্মদ আয়াস (ছদ্মনাম) নামের ২৫ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা যুবক সংবাদমাধ্যমটিকে সশস্ত্র প্রস্তুতির আদ্যোপান্ত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাদের লক্ষ্য, জান্তা বাহিনী ও অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে প্রতিহত করে নিজেদের ভূমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। তারা এ প্রস্তুতি দীর্ঘদিন ধরে নিচ্ছেন। বিশেষ করে মিয়ানমারে ২০২১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর এ প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত হয়।
২০২৪ সালের জানুয়ারির এক ভোরে ইন্ডিপেনডেন্টের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ আয়াস। তখন কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে তিনি বনের গভীর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে তিনি কোথাও পালাচ্ছিলেন না। ফিরছিলেন মিয়ানমারে, যেখান থেকে ২০১৭ সালে পালাতে হয়েছিল তাকে। ওই সময় মিয়ানমারের সেনাদের ‘গুলির বৃষ্টিতে’ তার বাবা প্রাণ হারিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, যারা তার পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে এবং তাদের এসব দুর্ভোগের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারা।
চার বছর বয়সী মেয়ে সন্তানের বাবা আয়াস, তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশুদের বার্মিজ ভাষা শেখান, তিনি জানিয়েছেন, তার মতো শত শত যুবক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা তাদের পথের বাধা হবে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা সবাই এক।
আয়াস বলেন, “আমরা প্রস্তুত। আমি আমার জনগণের জন্য মরতে প্রস্তুত। নিজ মার্তৃভূমিকে পুনরুদ্ধার, মিয়ানমারে আমাদের অধিকার ও স্বাধীনতার যুদ্ধে আমার কী হবে, এ নিয়ে আমি ভাবি না।”
কক্সবাজারের ক্যাম্পে কয়েক বছর ধরে থাকা হাজার হাজার রোহিঙ্গা যুবক স্ব-ইচ্ছায় সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছেন বলে দাবি তার।
সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্ট একাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছে। যাদের মধ্যে ছিলেন এক গম্ভীর ব্যক্তি, যিনি নিজেকে কমান্ডার হিসেবে দাবি করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তারা গোপনে মিয়ানমারে যান। যেখানে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসব্যাপী সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন।
রোহিঙ্গা যুবক আয়াস জানিয়েছেন, জঙ্গলে তিনি ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের অবস্থান যেন কেউ শনাক্ত না করতে পারে সেজন্য তারা প্রতিদিনই নিজেদের তাঁবু অন্যত্র সরিয়ে নিতেন। তিনি জানিয়েছেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো মিয়ানমারের গভীর জঙ্গলে। যা তাদের সশস্ত্র আন্দোলনকে গোপন রাখতে সহায়ক হচ্ছে। একই সঙ্গে বর্বর গৃহযুদ্ধ থেকেও তারা কিছুটা মুক্তি পাচ্ছেন।
আয়াস বলেছেন, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জাগিয়ে তোলা হতো। তাদের প্রশিক্ষণের শুরুটা হয়েছিল সাধারণ শারীরিক কসরতের মাধ্যমে। এরপর তাদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়। যাদের কেউ কেউ অস্ত্র ও গুলি নিয়ে প্রশিক্ষন নিতেন। কাউকে শেখানো হতো মার্শাল আর্ট। অপরদিকে গ্রুপের অন্যান্যদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চালানো, নজরদারি চালানো, শত্রুদের চলাচলের ওপর নজর রাখা এবং কৌশলগত তথ্য সংগ্রহ করা।
সকালের প্রশিক্ষণের পর দুপুরে তারা গোসল, খাওয়া-দাওয়া এবং আরাম করতেন। এরপর শুরু হতো প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় ধাপ।
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের পরিবেশের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক রোহিঙ্গা যুবক স্ব-ইচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে অস্ত্র তুলে নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আয়াস বলেন, “আমাদের প্রধান লক্ষ্য শান্তি। আমরা মিয়ানমারে শান্তি ও অধিকার নিয়ে বাস করতে চাই। যেখানে সরকার এবং বিদ্রোহীরা আমাদের জমি দখল করে নিয়েছে। আমরা আমাদের মাতৃভূমি ফেরত চাই এবং এজন্য আমরা লড়াই করব।”
কোন গ্রুপের সঙ্গে আয়াস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, সেটি তিনি প্রকাশ করেননি। তবে তিনি দাবি করেছেন, এই গ্রুপে এক হাজারের বেশি মানুষ যোগ দিয়েছেন যারা এখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিনি জানান, প্রত্যেকটি ক্যাম্প থেকেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য লোকবল নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশের ক্যাম্প আমাদের বাড়ি নয়। এখানে আমরা আর থাকতে চাই না। আমরা নিজ জন্মভূমিতে ফিরে যাব।”
আয়াস ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যান। যখন দেশটির সেনাবাহিনী বৌদ্ধ সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সাথে পুরো রোহিঙ্গা গ্রামে সমন্বিত গণহত্যা শুরু করে। যেখানে নারী-পুরুষ-শিশু কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধের ফলে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী মুসলিম সংখ্যালঘুরা দুই পক্ষের দ্বারাই আক্রান্ত হয়েছে, যা তাদের বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত এবং শ্রীলঙ্কায় পালাতে বাধ্য করেছে।
সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্ট কথা বলেছে আবু নিয়ামত উল্লাহ নামে (ছদ্মনাম) ৪২ বছর বয়সী অপর এক ব্যক্তির সঙ্গে। যিনি ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া রোহিঙ্গা ইসলামপন্থি সশস্ত্র দল ইসলামিক মাহাজের সঙ্গেও যুক্ত আছেন তিনি। ইসলামিক মাহাজের সঙ্গে ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন’ (আরএসও)- এর সংশ্লিষ্টতা আছে।
আবু নিয়ামত উল্লাহ বলেন, “আমাদের প্রথম শত্রু হলো (মিয়ানমারের) সেনাবাহিনী। যারা আমাদের মানুষের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। আমাদের দ্বিতীয় শত্রু হলো আরাকান আর্মি।”
নিয়ামত জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পুরুষরা মিয়ানমারে প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছেন। এরপর ক্যাম্পে ফিরে এসে একেবারে সাধারণ জীবনযাপন করছেন তারা।
তিনি বলেন, “কমান্ডার আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী তরুণদের টার্গেট করার জন্য। যারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী। আমরা কাউকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে জোর করি না। কিন্তু তাদের জিজ্ঞেস করি তারা মিয়ানমারে ফিরতে চায় কি না। যতি তারা চায়, আমরা তাদের পথ দেখাই। এ প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ মিয়ানমারে প্রশিক্ষণের জন্য যায়। ফিরে আসে। এরপর অন্যরা যায়।”
গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচির বাবা অং সানের ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বলেছেন আবু নিয়ামত উল্লাহ। তিনি জানিয়েছেন, অং সান যখন সরকার প্রধান ছিলেন তখন তিনি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তার প্রত্যাশা অং সান সুচি যদি মুক্তি পান তিনিও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করবেন। তবে তিনি নিশ্চিত নন সুচি এমনটি করবেন কি না। তাই তার মতে, স্বার্থ উদ্ধারে রোহিঙ্গাদের নিজেদেরই কাজ করতে হবে। যেটি করার সময় এখন এসেছে।
দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট ‘রায়নেইং সো’ ছদ্মনামের এক জ্যেষ্ঠ কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলে। তিনি গোপনীয়তা বজায় রেখে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই অবস্থান করছেন। তিনি জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মি উভয়ের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করবেন। তিনি বলেন, “প্রথমে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এটি মিটমাট করার চেষ্টা করব। কিন্তু এটি যদি না হয় তাহলে আমরা মরার জন্য প্রস্তুত আছি। আমরা আমাদের জন্মভূমির জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে প্রস্তুত। পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে লড়াই করার জন্য আমরা সব রোহিঙ্গাকে একত্রিত করার চেষ্টা করছি। যেন আমরা আমাদের ভূমি ও অধিকার ফিরে পাই।”
তিনি জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আরাকান আর্মিকে তারা সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু আরাকান আর্মি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ছদ্মনামের এই কমান্ডার বলেছেন, “আরাকান আর্মি মুসলিমদের সঙ্গে কাজ করতে চায় না। তারা শুধুমাত্র বৌদ্ধদের সঙ্গে কাজ করতে চায়। কিন্তু এখন সেনাবাহিনী বা আরাকান আর্মি যেই আমাদের পথের মাঝে আসুক, আমাদের নিজ ভূমি উদ্ধারে আমরা তাদের সবাইকে ধ্বংস করব।”
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি সশস্ত্র দল রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
সশস্ত্র দলগুলো জোরপূর্বক কাউকে দলভুক্ত করার অভিযোগ অস্বীকার করলেও, এ ধরনের ঘটনার নজির রয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস গ্রুপের পরিচালক জন কুইনলে জানিয়েছেন, তারা রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীতে (স্ব-ইচ্ছায় বা জোরপূর্বক) যুক্ত করার বিষয়টি তদন্ত করছেন। তিনি জানিয়েছেন, তাদের কাছে তথ্য এসেছে, ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে ক্যাম্প থেকে তুলে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার আমলে রোহিঙ্গাদের ওপর যে ধরনের বিধিনিষেধ ছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারও সেটি ধরে রেখেছে। এতে রোহিঙ্গাদের চলাচলের খুব স্বাধীনতা নেই। তারা ঠিকমতো শিক্ষাও পায় না। এ কারণে অনেক রোহিঙ্গা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করবে। এর অংশ হিসেবে তারা সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ফর্টিফাই রাইটস গ্রুপ এক প্রতিবেদনে অপর একটি সংগঠনের বরাতে জানায়, শুধুমাত্র গত বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত অন্তত দুই হাজার রোহিঙ্গা সশস্ত্র দলে যোগ দেয়। তাদের বিভিন্ন আশ্বাস, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং অনেক সময় জোর করে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনটির পরিচালক জন কুইনলে জানিয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউএসএইডের সহায়তা বন্ধ করে দিচ্ছেন। গত বছর রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা এসেছে সেটির ৫৫ শতাংশই দিয়েছিল ইউএসএইড। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যদি এই সহায়তা বন্ধ হয় রোহিঙ্গারা আরও আশাহীন হয়ে পড়বে। তখন তাদের মধ্যে সশস্ত্র লড়াইয়ের আকাঙ্খা আরও বাড়তে পারে।
এসব বিষয়ে জানতে দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্সন কমিশনার ও শরণার্থী ক্যাম্প অফিস এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে এ ব্যাপারে কোনো জবাব দেওয়া হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :