
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ মো. নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নিহা আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষ্যে এই জবানবন্দি দেন।
ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বেঞ্চ তার জবানবন্দি রেকর্ড করে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তিনি।
সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন শহীদ নাদিম মিজানের স্ত্রী। তার সঙ্গে তিন বছরের ছেলে আনাস বিন নাদিম। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই স্বামী হত্যার পুরো বর্ণনা তুলে ধরেন নিহা। একইসঙ্গে বিচার চেয়েছেন।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘আমার নাম তাবাসসুম আক্তার নিহা। আমি একজন গৃহিণী। আমার স্বামী শহীদ নাদিম মিজান তিনি রামপুরা বনশ্রী এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা করতেন। আমার দুই ছেলে। বড় ছেলের নাম আনাস, বয়স চার বছর তিন মাস। ছোট ছেলের নাম মো. আহনাফ, বয়স তিন বছর।
১৯ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার আমার স্বামী জুম্মার নামাজ পড়তে রামপুরা থানার সামনের মসজিদে যায়। ঐ দিন আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটে স্থানীয় লোকজন রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার স্বামীকে বাসায় নিয়ে আসে।
আমি দেখতে পাই আমার স্বামীর পেট থেকে রক্ত ঝরছিল। আমি আমার স্বামীর এই অবস্থা দেখে অজ্ঞান হয়ে যাই। আনুমানিক ৫/১০ মিনিট পরে জ্ঞান ফিরলে আমি জানতে পারি আমার স্বামীকে স্থানীয় অ্যাডভান্স হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাইরে তখন অনবরত গুলি হচ্ছিল, তাই আমি হাসপাতালে যেতে পারি নাই। আমার স্বামীকে হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। এই কথাটি আমি যারা হাসপাতালে নিয়ে গেছে তাদের কাছ থেকে শুনেছি। পরে আমি জানতে পারি নামাজ শেষে আমার স্বামী মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর থানার সামনে পুলিশ এবং বিজিবির ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়।
হাসপাতাল থেকে নাদিমের লাশ বাসার নিচে আনলে রামপুরা থানার পুলিশ লাশ নিয়ে যেতে চায়, তখন আমরা নাদিমের লাশ দোতলায় আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। ওই সময় আমাদের বাসায় ও বাসার আশেপাশে প্রচুর আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা জড়ো হয়। তখন হেলিকপ্টার থেকে আমাদের বাড়ি ও ছাত্রজনতাকে লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, রাত আনুমানিক ১০টার দিকে এ্যাম্বুলেন্সে করে আমার স্বামীর লাশ তার বাড়ির পাশে মিরপুর ১ নং ঈদগাহ মাঠে নেওয়া হয়। আনুমানিক রাত ১১টার দিকে তার জানাজা হয়। জানাজা শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। আমার স্বামীকে হত্যার জন্য শেখ হাসিনা এবং যে পুলিশরা গুলি করেছে তারা দায়ী।
আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই।
এ ছাড়াও মো. ইয়াকুব নামে একজন আজ সাক্ষ্য দেন।
সাক্ষীদের জেরা করেন পলাতক তিন আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী আমির হোসেন ও গ্রেফতার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, সাইমুম রেজা তালুকদারসহ অন্যরা।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই দিন এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারওয়ার জাহান। আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনান তিনি। এরপর নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন আসামি চঞ্চল। ১৬ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি এ মামলা থেকে চার আসামির অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন।
এ মামলায় গ্রেফতার রয়েছেন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার। হাবিবুর ছাড়া পলাতক বাকি তিন আসামি হলেন- খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভুঁইয়া। গত ১০ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে, ১ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২৫ আগস্ট পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ৭ আগস্ট প্রসিকিউশনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ। গত ৩১ জুলাই চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে রামপুরায় হোটেলে কাজ শেষে ঢাকায় থাকা ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কের দুই পাশে পুলিশ-বিজিবির গাড়ি দেখে ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে পাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন চারতলা ভবনের ছাদে ওঠেন তিনি।
ওই সময় পুলিশও তার পিছু পিছু যায়। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই নির্মাণাধীন ভবনটির ছাদের কার্নিশের রড ধরে ঝুলে থাকেন আমির। কিন্তু তাকে দেখে ফেলে পুলিশ। পরে তার ওপর ছয়টি গুলি ছোড়েন এক পুলিশ সদস্য। এতে তিন তলায় পড়ে গেলে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন উদ্ধার করেন। এরপর বনশ্রীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওইদিন রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন ভুক্তভোগী এই তরুণ। এছাড়া একই দিন রামপুরার বনশ্রী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নাদিম ও মায়া ইসলাম নিহত হন। একইসঙ্গে মায়া ইসলামের ছয় বছর বয়সি নাতি বাসিত খান মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিলেও এখনো কথা বলতে পারছে না এই শিশু।
গত ২৬ জানুয়ারি রাতে আমির হোসেনকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো সাবেক এএসআই চঞ্চল সরকারকে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে গ্রেফতার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহার নেতৃত্বাধীন ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল।
বাসস
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                        
                        
                        
                        
                        
                        
                        
আপনার মতামত লিখুন :