‘কোরবানি’ শব্দটি আরবি ‘কুরব’ শব্দমূল থেকে উদ্ভুত। যার অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ বা কাছাকাছি আসা। কুরব থেকে এসেছে কোরবান শব্দটি যার অর্থ আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য কোন কিছু উৎসর্গ করা। ইসলামি পরিভাষায় কোরবানি বলতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহর নামে পশু জবেহ করাকে বোঝায়। জিলহজ্ব মাসের ১০ হতে ১২ তারিখের মধ্যে যে কোন দিন কোরবানি আদায় করা যায়। তবে ১০ জিলহজ্ব অর্থাৎ প্রথম দিন কোরবানি করা উত্তম।
কোরবানি দ্বীনের জন্য আল্লাহর রাস্তায় সর্বোচ্চ ত্যাগের মহৎ শিক্ষা। শুধু আত্মত্যাগই নয়, আল্লাহর সঙ্গে বান্দার ভালোবাসার এ এক অনন্য নিদর্শন। কোরবানির উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা, তাকওয়ার মাধ্যমে ত্যাগ ও বিসর্জনের ঈদ হলো ঈদ উল আযহা। স্রষ্টার ভালোবাসায় নিজের ভোগবিলাস, লোভ লালসা, ক্রোধ ও হিংসাকে বিসর্জন দেয়ার উত্তম শিক্ষা রয়েছে কোরবানির মধ্যে। যারা নফসের কোরবানি করে তারা পরিশুদ্ধতা অর্জন করে।
কোরবানির কথা শুনলে আমাদের সামনে চলে আসে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) এর সেই অগ্নিপরীক্ষার ঘটনা। কিন্তু কোরবানির ইতিহাস ততটা প্রাচীন, যতটা প্রাচীন দ্বীন-ধর্ম বা মানব জাতির ইতিহাস। পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) এর পুত্রদ্বয় হাবিল ও কাবিলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মেটাতে মহান আল্লাহ তায়ালা কোরবানির আদেশ দিয়েছিলেন। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কোরবানি। এরপর সব উম্মতের মাঝে কোরবানির বিধান চালু ছিল। সূরা হজ্জ এর ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান করে দিয়েছি, যাতে তারা উক্ত পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে, তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ, কাজেই তারই কাছে আত্মসমর্পণ কর এবং সুসংবাদ দাও বিনীতদেরকে’। মানবজাতির জন্য যত আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছে, প্রত্যেকটির মধ্যে কোরবানির বিধান চালু ছিল।
মুসলিম সমাজে বর্তমানে কোরবানির যে বিধান চালু রয়েছে তা মূলত মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সুন্নাত। আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহীম (আ.) কে বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনি সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সূরা আল বাকারার ১২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখন ইব্রাহিম (আ.) কে তার রবের কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, আমি তোমাকে নেতা বানাবো। নিজ পুত্র জবেহ করার মত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ.)। এ বিষয়ে সূরা আস-সাফ্ফাতের ১০০ থেকে ১০৮ আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি বললেন, হে প্রভু, আমাকে নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম এক অতীব ধৈর্যশীল সন্তানের। পরে যখন সে সন্তান তার সাথে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ানোর বয়সে পৌঁছলো তখন তিনি ইব্রাহিম (আ.) একদিন বললেন, হে বৎস ! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাকে জবেহ করছি এখন তুমি চিন্তা ভাবনা করে দেখ এবং তোমার অভিমত কী? তিনি ইসমাঈল বললেন, হে পিতা আপনি তাই করুন যা করতে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। অতঃপর যখন দুইজনই আল্লাহর আদেশ মানতে রাজি হলেন, তখন তিনি ইবরাহীম (আ.) পুত্রকে জবেহ করার জন্য শুইয়ে দিলেন। আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম ! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই নেক বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি বড় পরীক্ষা। আর আমি তাকে বিনিময় করে দিলাম এক বড় কোরবানির দ্বারা এবং তা পরবর্তীর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম।
মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় আল্লাহ প্রদত্ত কঠিনতম পরীক্ষায় পিতা কর্তৃক পুত্রকে কোরবানি করার মধ্য দিয়ে যে ধৈর্যশীলতার নজির স্থাপন করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কুরআন মজিদে উল্লিখিত আয়াতসমূহে ইব্রাহীম এবং ইসমাঈল (আ.) এর আত্মত্যাগ এবং রবের প্রতি সীমাহীন আনুগত্যের উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে স্বীয় পুত্র জবেহ না হয়ে দুম্বা জবেহ হওয়ার মাধ্যমে উম্মতে মোহাম্মদী (সা.) এর ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়।
আল্লাহর প্রতি শর্তহীন আনুগত্য, ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষা আছে কোরবানিতে। সূরা কাউসারের ২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে নির্দেশ দিয়েছেন, আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, হে রাসুল আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ রাব্বুল আলামিনের জন্য উৎসর্গিত (সূরা আনআম ১৬২)
কোরবানির মাধ্যমে আমাদের খোদাভীতি অর্জন করতে হবে। অন্যায় ও অপকর্ম এবং মহান রব যা করতে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করতে হবে। সূরা হজ্জ এর ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহর কাছে কখনোও কোরবানির গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে।
যেহেতু কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয় সেজন্য কোরবানির গোশত কারো জন্য খাওয়া জায়েজ হওয়ার কথা নয় বিশেষ করে কোরবানিকারীর জন্য। কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানিতে কোরবানির গোশত খাওয়া সকলের জন্য জায়েয। এ প্রসঙ্গে সূরা হজ্জ এর ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর কোরবানির উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি; তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। যখন সেগুলি কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে খাও। যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী চেয়ে বেড়ায়-তাদেরকে খেতে দাও। এভাবেই আমি এগুলোকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
কোরবানির গোশত বণ্টন ফরজ বা ওয়াজিব নয়। তবে অধিকাংশ আলেম ওলামাদের মতে, কোরবানির পশুর গোশতকে তিন ভাগে ভাগ করা মোস্তাহাব এবং উত্তম। আমাদের সমাজে কোরবানির গোশত বণ্টনের যে নিয়ম প্রচলিত রয়েছে তার নিন্দা না করে বলা যায়, আমাদের সমাজে যারা অসহায়, অভাবী, মিসকিন রয়েছে যারা কোরবানি করতে পারেনি, তাদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের বাড়িতে গিয়ে কোরবানির গোশত পৌঁছে দেয়া যেতে পারে। এতে তারা সম্মানিত বোধ করবেন। এক মুমিন আরেক মুমিনকে সম্মান করবে এটাই ইসলামের সৌন্দর্য। এছাড়াও অসহায় যারা বাসায় গোশত নিতে আসবে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে তাদের হাসিমুখে বিদায় করতে হবে। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের নিকটও গোশত পৌঁছে দিলে তাদের উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতা তৈরি হয়। হাদিসে প্রকৃত মুমিন তাকেই বলা হয়েছে, যে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অন্য মুমিনের জন্যও তাই পছন্দ করে থাকে আর নিজের জন্য যা অপছন্দ করে, অন্যের জন্যও তা অপছন্দ করে। ইসলাম শিক্ষা দেয় নিজেকে সব মুমিন অপেক্ষা ক্ষুদ্র ভাবতে। বিশেষত কুরবানি তো আত্মত্যাগেরই প্রতীক। আমিত্ব, ত্যাগ ও অহমিকা বিসর্জনের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র বান্দারূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে কোরবানির উদ্দেশ্য কোনদিনই সফল হবেনা এবং মহান রবের নৈকট্য লাভ সম্ভব হবেনা।
কোরবানির শুরু অর্থাৎ পশু ক্রয় থেকে শুরু করে কোরবানি করা এবং কোরবানি শেষে পশুর উচ্ছিষ্টাংশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাসহ কোরবানি সকল প্রক্রিয়াই আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করতে হবে। এজন্য কোরবানির পশু ক্রয়ের জন্য হালাল অর্থ দরকার, হৃষ্টপুষ্ট ও সুস্থ পশু কোরবানির জন্য উত্তম, কোরবানির পশুর হক আদায়ে মনোযোগী হতে হবে, কোনোভাবেই পশুকে কষ্ট দেয়া যাবেনা। মনের মধ্যে রিয়া বজায় রাখা যাবেনা। কোরবানি হতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
ইসলামে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি শুধু শারীরিক নয়, বরং আত্মিক ও পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতার দিকেও গুরুত্ব দেয়। সূরা আল বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা নিজেদেরকে পবিত্র রাখে। সহিহ মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক’।
ইসলামে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শুধু শারীরিক নয়, বরং নৈতিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে এটি বাস্তবায়নযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি ইবাদতের পূর্বশর্ত। ইসলামের এ নির্দেশনা ও সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের আলোকে আমাদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় কোরবানি করতে হবে এবং নিজে এককভাবে একটি জায়গায় কোরবানি করলে কোরবানি উচ্ছিষ্টাংশ মাটিতে পুঁতে দিতে হবে বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত জায়গায় ফেলতে হবে। এছাড়া কোরবানির জায়গাগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্গন্ধ যেন চারিদিকে ছড়িয়ে না পড়ে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমার দ্বারা কেউ যেন কষ্ট না পায়। আমরা যদি কোরবানির শিক্ষা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে আমার মাওলা আমার উপর খুশি থাকবে। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধিত হবে। ফলে সমাজ, দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
মো: আতিকুর রহমান শাহ্
সিনিয়র তথ্য অফিসার
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী।
আপনার মতামত লিখুন :