সততা সংঘ : দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রাথমিক পাঠ


editor প্রকাশের সময় : মার্চ ১৫, ২০২৫, ২:৪৭ অপরাহ্ণ /
সততা সংঘ : দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রাথমিক পাঠ

 

দুর্নীতি একটি সমাজ বিধ্বংসী ব্যাধি। এটি একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। তাই দুর্নীতি প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি ও সততার চর্চা বাড়ানোর লক্ষ্যে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে ‘সততা সংঘ’। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৎ ও নৈতিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সততা সংঘ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করে, যা ভবিষ্যতে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে। শিক্ষার্থীরা যদি ছোটোবেলা থেকেই সততার চর্চা করে, তবে তারা ভবিষ্যতে নৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারবে এবং দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে অবদান রাখবে।
এটি মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক একটি সংগঠন যা তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে এবং তাদের মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সততার মূল্যবোধ গড়ে তোলে। সততা সংঘ মূলত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক পরিচালিত একটি সংগঠন, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত হয়। ২০০৮ সালে এ কার্যক্রম শুরু হলেও পরবর্তীতে এটি দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নেয় এবং সততার চর্চাকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার জন্য কাজ করে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির গঠনতন্ত্র ও কার্যনির্দেশিকা-২০১০ এর ১৮(ক), (খ) ও (গ) অনুচ্ছেদে ‘সততা সংঘ’ গঠনের বিধান রয়েছে। উক্ত বিধানের আলোকে দেশব্যাপী ইতোমধ্যেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সততা সংঘ’ গঠিত হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টি করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে তোলার কার্যক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে স্ব স্ব কর্ম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথা স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেসকল প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদিতে জেলা/উপজেলা/মহানগর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সততা সংঘ কাজ করবে।
২০২৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম অবস্থানে নেমে গেছে, যা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোয় দুর্নীতির বিরাজমান পরিস্থিতিকে আরও উন্মোচিত করছে। বাংলাদেশের স্কোর এক বছরে দুই পয়েন্ট কমে ২৩-এ নেমেছে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নমুখী। ভুটান ৭২ স্কোর নিয়ে ১৮তম স্থানে, ভারত ও মালদ্বীপ ৩৮ স্কোর নিয়ে ৯৬তম স্থানে, নেপাল ৩৪ স্কোর নিয়ে ১০৭তম স্থানে, শ্রীলঙ্কা ৩২ স্কোর নিয়ে ১২১তম স্থানে এবং পাকিস্তান ২৭ স্কোর নিয়ে ১৩৫তম স্থানে রয়েছে। এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের সরকার, জনগণ এবং সুশীল সমাজের জন্য একটি সতর্ক সংকেত, যা দেশের ভবিষ্যৎ সুশাসন ও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেয়।
সততা সংঘের কার্যনির্বাহী কমিটি ১১ জন শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে গঠিত হবে। সদস্য নির্বাচন মেধার ভিত্তিতে করা হবে, তবে দুর্নীতি প্রতিরোধমুলক সামাজিক কার্যক্রমে আগ্রহী শিক্ষার্থীদেরও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। স্কুল ও মাদ্রাসা পর্যায়ে ৬ষ্ঠ-১০ম শ্রেণি থেকে ৮ জন শিক্ষার্থী এবং ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কাজে পারদর্শী ৩ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কলেজ পর্যায়ে একাদশ থেকে স্নাতক পর্যন্ত ৮ জন শিক্ষার্থী এবং একইভাবে ৩ জন বিশেষ পারদর্শী সদস্য মনোনীত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও প্রতিটি শ্রেণি থেকে ৮ জন শিক্ষার্থী এবং ৩ জন বিশেষ পারদর্শী সদস্য নির্বাচন করা হবে। এছাড়া, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ক্ষেত্রেও মেধার ভিত্তিতে ৮ জন শিক্ষার্থী এবং ৩ জন বিশেষ পারদর্শী সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
সংঘের কার্যনির্বাহী কমিটির কাঠামোর মধ্যে সভাপতি, সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ এবং সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি ও পরামর্শক কাউন্সিলের সহায়তায় সদস্য নির্বাচন করা হবে এবং সদস্যদের মধ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রী অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উৎসাহিত করা হবে। সততা সংঘ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস ও সপ্তাহ উদযাপনে ভূমিকা রাখবে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সততা ও নিষ্ঠাবোধ জাগিয়ে তুলতে কাজ করবে। সংঘের কোনো সদস্যের পদ শূন্য হলে তা দ্রুত পূরণ করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই নীতিমালা সততা সংঘের কাঠামো ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে, যা শিক্ষার্থীদের দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে।
সততা সংঘের সভা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আয়োজন করা হবে যা স্ব-উদ্যোগে বা সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির অনুরোধে ডাকা যেতে পারে। প্রতি মাসে অন্তত একটি সভা আয়োজন করা বাধ্যতামূলক। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রতিটি সিদ্ধান্ত সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত হবে। কোনো সদস্য দ্বিমত পোষণ করলে তা সিদ্ধান্ত বইতে লিপিবদ্ধ করার সুযোগ থাকবে। সভার কার্যবিবরণী পৃথক রেজিস্টারে সংরক্ষণ করা হবে, যাতে সদস্যদের উপস্থিতি, আলোচনার বিষয়বস্তু এবং গৃহীত সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত থাকবে। পরবর্তী সভায় তা পুনরায় পড়া ও অনুমোদন করা হবে এবং একটি অনুলিপি সংশ্লিষ্ট জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির নিকট পাঠানো হবে।
সততা সংঘের কার্যাবলি সুচারুরূপে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে একটি পরামর্শক কাউন্সিল থাকবে। পরামর্শক কাউন্সিল ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি যেখানে একজন শিক্ষিকাসহ তিনজন শিক্ষক প্রতিনিধি, স্কুল/কলেজ/মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির একজন অভিভাবক সদস্য এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির একজন প্রতিনিধি থাকবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এই কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত শিক্ষককে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করতে পারবেন। পরামর্শক কাউন্সিলের দায়িত্ব হলো সততা সংঘ গঠন ও পুনর্গঠন, শিক্ষার্থীদের দুর্নীতি বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রচারণামুলক কার্যক্রমে সহযোগিতা, বক্তৃতা, বিতর্ক ও রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন, মতবিনিময় সভা ও আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা, দুর্নীতি বিরোধী পদযাত্রার আয়োজন এবং নৈতিকতা উন্নয়নমুলক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা। এটি শিক্ষার্থীদের সততা, নৈতিকতা ও দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সততা সংঘের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। তরুণ প্রজন্মকে দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের মধ্যে সততা ও নৈতিকতার চর্চা বাড়ানো এর অন্যতম উদ্দেশ্য। সততা সংঘের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- দুর্নীতিবিরোধী সভা, সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন; সততা স্টোর পরিচালনা, যেখানে কোনো বিক্রেতা ছাড়াই শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করতে পারে এবং নির্ধারিত মূল্য বাক্সে রেখে যায়; দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাটক, বিতর্ক, রচনা প্রতিযোগিতা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা; দুর্নীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রচারপত্র, দেয়ালিকা ও পোস্টার তৈরি এবং স্থানীয় প্রশাসন ও গণমাধ্যমের সঙ্গে সমন্বয় করে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা।
সততা সংঘ ও সততা স্টোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ, সততা ও নৈতিকতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসব কার্যক্রমের ফলে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই সৎ ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। দুর্নীতিবিরোধী চেতনা গড়ে ওঠার পাশাপাশি তারা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে উদ্বুদ্ধ হয়। অনেক শিক্ষার্থী পরবর্তীতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সততা সংঘের কার্যক্রমের পরিধি সম্প্রসারণে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, প্রশাসনিক সহযোগিতার অভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক বাধাও এ কার্যক্রমের সফলতার পথে অন্তরায় হতে পারে। তাই দুর্নীতি দমন কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে সততা সংঘের কার্যক্রম আরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত করা যায়।
সততা সংঘ ও সততা স্টোরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা ও সততার চর্চার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে। তরুণদের সৎ, দায়িত্বশীল ও নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এ ধরনের কার্যক্রমকে আরও জোরদার করতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার ভিত্তি মজবুত করা অত্যন্ত জরুরি। সততা সংঘ সেই পরিবর্তনের এক সফল হাতিয়ার হতে পারে, যদি একে সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতায় আরও শক্তিশালী করা যায়।
সততা সংঘ শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক সংগঠন নয় বরং এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। দুর্নীতিমুক্ত ও নৈতিকতা সম্পন্ন সমাজ গঠনে এর কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক এবং সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৎ, নীতিবান ও আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। সততা চর্চার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক: মো. খালিদ হাসান
সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর
পিআইডি ফিচার