শেখ মোহাম্মদ আসলাম : বাংলাদেশ ফুটবলের সোনালি অতীত


editor প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ১৩, ২০২৫, ৩:০০ অপরাহ্ণ /
শেখ মোহাম্মদ আসলাম : বাংলাদেশ ফুটবলের সোনালি অতীত

বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের কজনের নাম তারা বলতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়। অথচ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফুটবলই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। এমন একজন ছেলেও পাওয়া যেত না, যে জীবনে ফুটবল খেলেনি। আমাদের ফুটবলারদের ক্রীড়া নৈপুণ্য মানুষ হৃদয় দিয়ে উপভোগ করত। স্বাধীনতা-উত্তর ফুটবলে আমাদের খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য কেবল দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তা ছড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। সেই সময় মারদেকা কাপ, প্রীতি ম্যাচ কিংবা এশিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের ফুটবলাররা নিয়মিত পারফর্ম করতেন। আবাহনী, মোহামেডান কিংবা ব্রাদার্স ইউনিয়নের মতো ক্লাবগুলো মাঠে লাখো দর্শকের ভিড় টানত। ফুটবল মাঠ শুধু খেলার জায়গা নয়, বরং জাতির আবেগ, উচ্ছ্বাস আর একতার প্রতীক।
দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন, মালদ্বীপ, ভুটান, এমনকি আর্জেন্টিনা একাদশের বিরুদ্ধেও গোল আছে আমাদের দেশেরই এক কৃতি ফুটবলারের। বর্তমান প্রজন্ম কি তাকে চেনে? ১৯৮৩ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ২৭তম মারদেকা ফুটবল প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনা একাদশের বিরুদ্ধে গোল করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন সেই সময়ের তরুণ ফুটবলার। যদিও সেই খেলায় বাংলাদেশ ৫-২ গোলে হেরেছিল। সেই ফুটবলার হলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম, যাকে দেশবাসী স্ট্রাইকার আসলাম বা আবাহনীর আসলাম নামেই চেনে।
তিনি তার ৭ ভাই-বোনের মধ্যে ষষ্ঠ। ছোটোবেলায় ফুটবলের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল । তার বড়ো মামা ফুটবলার ওয়াসিফুর রহমান কিশোর আসলামের ফুটবল প্রতিভা দেখে অবাক হয়েছিলেন। তাই তিনি নিজের বোন অর্থাৎ আসলামের মায়ের বিরোধিতা সত্ত্বেও আসলামকে ফুটবল খেলায় আগ্রহী করে তুলেন। যদিও ফুটবল খেলার বিষয়ে আসলামের বাবার সব সময় সম্মতি ছিল। আসলাম পল্লি মঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে লং জাম্পে দ্বিতীয়, জ্যাভেলিনে ও শুটপুটে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে, ভিক্টোরিয়া ক্লাবের হয়ে খেলার মাধ্যমে তিনি তার জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেছিলেন। যদিও আসলাম ক্লাবে একজন ডিফেন্ডার হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, ভিক্টোরিয়ার তৎকালীন বুদ্ধিমান কোচ আব্দুর রহিম তার মধ্যে একজন স্ট্রাইকারের সম্ভাবনা দেখেছিলেন এবং ১৯৭৯ সালে তার অবস্থান পরিবর্তন করে তাকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলান। যেখানে তিনি ৩ মৌসুম অতিবাহিত করে ১৯৮০–৮১ মৌসুমে বিজেএমসি তে যোগদান করেন। বিজেএমসি তে যোগ দেওয়ার আগে ভিক্টোরিয়ার হয়ে তিনি ১৪টি গোল করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে, বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব -১৯ দলে আসলামের অভিষেক হয় । প্রায় ৩ বছর বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলে খেলার পর, ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিষেক হয়েছিল। ঐ বছরই ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় প্রেসিডেন্ট কাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে দুর্দান্ত খেলেন তিনি । প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একটি এবং নেপালের সঙ্গে একটি গোল করেন। আসলাম তার অভিষেক বছরেই বিজেএমসির হয়ে ১৩ গোল করে লাইমলাইটে এসেছিলেন এবং ১৯৮১ সালে বিজেএমসির অধিনায়ক হয়ে ছিলেন। বিজেএমসিতে তিন মৌসুম অতিবাহিত করার পর ঢাকা মোহামেডানের চলে আসেন, যেখানে তিনি ১৪টি গোল করেন। ইনজুরিতে আক্রান্ত হওয়ার পর ১৯৮৪–৮৫ মৌসুমে, ঢাকা মোহামেডান হতে ঢাকা আবাহনীতে যোগদান করেন এবং একাধারে ১০ মৌসুম খেলেন। আর এর মাধ্যমেই তিনি হয়ে ওঠেন আবাহনীর ঘরের ছেলে আসলাম। ১৯৮৪ সালে নয়াদিল্লিতে ডিসিএম ট্রফিতে আবাহনী ভারতের গুরখা ব্রিগেডকে ৪-১ গোলে এবং মালদ্বীপের ভ্যালেন্সিয়া ক্লাবকে ৮-১ গোলে পরাজিত করে। এ খেলায় আসলাম একাই পাঁচটি গোল করে। এর মাধ্যমে এ উপমহাদেশে ফুটবলে আসলামের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৫-৮৬ সালে এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ কলম্বোতে অনুষ্ঠিত হয় । এ টুর্নামেন্টে তিনি আবাহনীর হয়ে নয়টি গোল করে, শ্রীলঙ্কার সন্ডার্স এসসি র প্রেমলালের সাথে যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
১৯৮৯-৯০ মৌসুমে, আসলাম ১১ গোল করেছিলেন এবং পাঁচবার সর্বোচ্চ স্কোরার হওয়ার নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮-৮৯ মৌসুম পর্যন্ত, টানা পাঁচটি মৌসুমে প্রতিটি লীগে হ্যাটট্রিক করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি । ১৯৯১-৯২ মৌসুম পর্যন্ত টানা সাত মৌসুমে তিনি আবাহনীর হয়ে ১০৩ গোল করেন। আসলাম,তার ক্লাবের হয়ে ফেডারেশন কাপে ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত হ্যাটট্রিকের পাশাপাশি তিনটি লিগ ট্রফি জিতেছিলেন । ভারতের নাগজি ফুটবল টুর্নামেন্টের সাড়ে তিন দশকের ইতিহাসে , ১৯৮৯ সালে আবাহনী প্রথম বিদেশি দল হিসেবে টুর্নামেন্ট জিতেছিল। প্রথম ম্যাচে আবাহনী কেরালার ক্লাব চ্যাম্পিয়ন ট্রাভাঙ্কোর টাইটানিয়ামের বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতেছিল , খেলার ৮০তম মিনিটে রঞ্জিত সাহার থেকে বল পেয়ে গোল করেন আসলাম। ওই আসরে সেরা ফুটবলারের মুকুট উঠেছিল স্ট্রাইকার শেখ মোহাম্মদ আসলামের মাথায়। ফাইনালে তার গোলেই ভারতের সেসময়কার ফেডারেশন কাপ জয়ী সালগাওকারকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিলো আবহনী।
শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সর্বোপরি পরিশ্রমের মাধ্যমে সবচেয়ে সফল ও সেরা স্ট্রাইকারে পরিণত হন আসলাম। তৈরি সুযোগ ও হাফ চান্সগুলো কাজে লাগিয়ে গোল করা, দুরূহ সব পজিশন ও অ্যাঙ্গেল থেকে অবিশ্বাস্য গোল, উঁচুতে বল চ্যালেঞ্জে তাঁর সঙ্গে ডিফেন্ডারদের পেরে না ওঠা, সাইড ভলি, ব্যাকভলি, বাইসাইকেল কিক, প্লেসিং শট, লং ও ক্লোজ রেঞ্জে তীব্র শটে গোল করা কিংবা প্রতিপক্ষের গোলরক্ষককে কাঁপিয়ে দিয়ে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেন তিনি। ঢাকার মাঠে এমন গোলক্ষুধা আর কোনো স্ট্রাইকারের ছিল না। মাঠে নামার পর মুহূর্ত থেকেই গোল করার জন্য শিকারি বাঘের মত হন্য হয়ে উঠতেন। নানা কৌশলে আদায় করে নিতেন গোল।
ঘরোয়া আসরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও দাপটের সঙ্গে খেলেছেন আসলাম। তিনি ১৯৯১ সালে কলকাতা ফুটবল লিগে ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে খেলেছিলেন। ১৯৯১ সালে ডুরান্ড কাপে জর্জ টেলিগ্রাফ এসসি-র বিপক্ষে মাথায় আঘাতের কারণে তিনি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হন । তবে ক্লাবের হয়ে তার প্রথম গোলটিও একই ম্যাচে এসেছিল। ১৯৯১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কোলকাতার শীর্ষ ৩টি ও বাংলাদেশের শীর্ষ ৩টি ক্লাব নিয়ে আয়োজিত বিটিসি ক্লাব কাপে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রেও আসলামের কৃতিত্ব রয়েছে। কোলকাতা মোহামেডান এবং ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে তিনি একটি করে গোল করেন। ১৯৯১ সালে শ্রীলংকার কলম্বোয় অনুষ্ঠিত পঞ্চম সাফ গেমসে নেপালের সঙ্গে তিনি একটি গোল করেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত অষ্টম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তিনি বাংলাদেশের অধিনায়ক হয়েছিলেন। বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচে তিনি ইরানের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৯০ সালে চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়ে টানা চারটি এশিয়ান গেমসে অংশ নেয়ার গৌরব অর্জন করেন। আবাহনীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৯৩ সালে তিনি মোহামেডানে যোগ দিয়ে ৭টি গোল করেন। ১৯৯৪ সালে পুনরায় আবাহনীতে ফিরে এসে আরো ১৬টি গোল করে ১৯৯৬ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেন। পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতার আসলাম ফুটবল ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে তিন শতাধিক গোল করেছেন।
আসলামের অসংখ্য গোল, তার শৃঙ্খলা, পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা ফুটবল প্রেমীদের মাঝে এক অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গেছে। ১৯৯৬ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর, তিনি দেশের ক্রীড়া লেখক সমিতি ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে বিভিন্ন সময় সেরা ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃত হন। ২০০০ সালে তিনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার লাভ করেন, যা তার সাফল্যের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি।
আজকের দিনে, যখন দেশের ফুটবল খেলার মান এবং জনপ্রিয়তা অনেকটাই কমে গেছে, তখন শেখ মোহাম্মদ আসলামের মতো ফুটবলারের অবদান স্মরণ করা অত্যন্ত জরুরি। তার ক্যারিয়ারের গল্প আমাদের সবার জন্য একটি প্রেরণার উৎস। আসলাম তার জীবনে প্রমাণ করেছেন যে, পরিশ্রম, একাগ্রতা এবং ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের ফুটবলের অতীতের স্বর্ণযুগের অন্যতম নায়ক হিসেবে শেখ মোহাম্মদ আসলামের নাম চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন প্রাণ সঞ্চারের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং ভালো ফুটবল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের। সেই সঙ্গে শেখ মোহাম্মদ আসলামের মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের ইতিহাসকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে, যাতে তারা ফুটবলকে আবারও নিজের হৃদয়ে জায়গা দেয়।

ইমদাদ ইসলাম
পিআইডি ফিচার