স্টাফ রিপোর্টার: ৩০ বছর ধরে খয়ের তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মর্জিনা বেগম (৬৯)। দীর্ঘ এই সময়ে দেখেছেন খয়ের শিল্পের জৌলুস। এখন তিনি নিজেই এই শিল্প ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকার গল্পের সাক্ষী। শত বছরের শিল্পটি এক সময় রমরমা থাকলেও জৌলুস হারিয়ে ১০০ কারখানা থেকে কমে ১০টিতে নেমে এসেছে। খয়ের গাছ সঙ্কট, দাম না পাওয়া যাওয়াসহ নানা কারণে শিল্পটি এখন ধ্বংসের প্রান্তে।
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার গোপালপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল মর্জিনা বেগমকে খয়ের গাছের কাঠ চুলায় জ্বাল করতে। মর্জিনা বেগম জানান, ৩০ বছর ধরে খয়ের তৈরির কাজ করেন তিনি। কাজের অংশ হিসেবে তিনি ভোরে উঠে খয়ের কাঠ জ্বাল দেওয়ার চুলায় আগুন দেন। এরপরে তিনি ফজরের নামজ শেষ করেন। দীর্ঘ ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা জ্বালের পরে মাটির হাড়ি নামিয়ে খয়ের গাছের কষ আলাদা করতে হয়। এমনভাবে তার জ্বাল দেওয়ার কার্যক্রম চলে দুপুর পর্যন্ত।
তিনি বলেন, আগে চারঘাটে প্রতিটি ঘরে ছিল খয়েরের কারখানা। সবাই এই ব্যবসা করত। কিন্তু এখন আর কেউ এই ব্যবসা করে না। এই গোলাপপুরে ৮ থেকে ১০টা খয়েরের কারখানা রয়েছে। এই কাজে প্রচুর পরিশ্রম। সারাদিন আগুনের সামনে বসে থাকতে হয়। শরীর দিয়ে সমানে ঘাম ঝরে। তারপরেও কাজ করি যতদিন সুস্থ আছি কাজ করে যাব।
জানা গেছে, খয়ের গাছ কাঁটাযুক্ত পর্ণমোচী উদ্ভিদের কাঠ। এ মশলা পানের অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়। আর খয়েরশিল্পের জন্য বিখ্যাত রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা। চারঘাটের খয়েরের সারাদেশে সুনাম ছিল। একসময় বিদেশেও রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু এতো অর্জনের পরও বর্তমানে শিল্পটি বিলুপ্তির পথে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক সময় এ পেশায় জড়িত ছিল হাজারও মানুষ। কিন্তু ভারত থেকে খায়ের আসা ছাড়াও খয়ের গাছের সঙ্কটের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে এই শিল্পটি। তবে উৎপাদনের জন্য অনুকূল আবহাওয়া থাকলেও পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাবে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অন্য পেশায় চলে গেছে। এক সময় চারঘাটে প্রচুর খয়ের গাছ ছিল। এখন এই শিল্প যতটুকু টিকে আছে তা বরেন্দ্র অঞ্চল ছাড়াও নাটোরের আব্দুলপুর, লালপুর, বাগাতিপাড়া ও লোকমানপুরের খয়েরের গাছ দিয়ে। অতীতের রমরমা ভাব না থাকলেও অল্প পরিষদে এখনও চারঘাটে খয়ের গাছের হাট বসে।
খয়ের শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৯৫ সালে ‘চারঘাট বাজার খয়ের ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি’ গঠন করেন। পরবর্তীতে সেই সমিতির কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পঞ্চাশের দশকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা বিহারীরা এ শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসার ঘটায়। তাদের উৎপাদিত খয়ের ঢাকা, দিনাজপুর, রংপুর ও ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হতো। এখনও এই সব অঞ্চলে চারঘাটের খয়ের পাঠানো হয়। চারঘাটে বেশিরভাগ খয়ের কারখানাগুলো ছিল গোপালপুর ও বাবুপাড়া গ্রামে।
খয়েরের গাছ বিক্রেতা এনামুল হক বলেন, খয়ের একেবারে বিলুপ্ত পর্যায়ে। আগে প্রায় ১০০টি ছোট-বড় খয়েরের কারখানা ছিল। সেখান থেকে কমে এখন ১০ থেকে ১৫টি রয়েছে। একটি খয়ের গাছ তৈরি হতে কমপক্ষে সময় লাগে ৩০ বছর। কিন্তু এখন খয়ের উৎপাদনের চেয়ে আমচাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন কৃষকরা। এছাড়া মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা খয়েরের দাম তুলনামূলকভাবে কম। এ কারণে ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা থাকলেও ব্যবসায়িক স্বার্থে অধিক মুনাফা লাভের আশায় আমদানি করা খয়েরের ওপর দিন দিন নির্ভরশীলতা বাড়ছে।
গোপালপুরের খয়ের উৎপাদনকারী একটি কারখানার স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও গাছের সংকটে একে একে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় কেউ কেউ নিজস্ব পুঁজি বিনিয়োগ করে উৎপাদিত খয়ের বাকিতে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অধিকাংশ কারখানায় মূলধন সংকট দেখা দিলেও সরকারি সহযোগিতা থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত। এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি দরকার স্বল্পসুদে ব্যাংকঋণ। পাশাপাশি আমদানি নিরুৎসাহিত করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
চারঘাট বাজার খয়ের ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল রাজ্জাক বলেন, খয়ের গাছ পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না। খয়ের গাছের প্রচুর অভাব। তাই এই গাছ বেশি দামে কেনাবেচা হয়। এক সময় চার ঘাটে একশর বেশি কারখানা ছিল। বর্তমানে ৮ থেকে ১০টি কারখানা টিকে আছে। তাও খায়ের গাছের হবে ধুঁকছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের এদিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে খয়ের আসে। এ খয়ের থেকে আমাদের খয়রের গুণগত মান ভালো। বেশিরভাগ ঢাকা, রংপুর, ঠাকুরগাঁওতে বিক্রি হয়। বাজার ব্যবস্থা খুবই ভালো। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আবারও এই শিল্পটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করেন।
চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইদা খানম বলেন, খয়ের নিয়ে কাজ করা মানুষগুলো অন্য পেশায় চলে গেছে। খয়েরের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লেখা হয়েছে। একই সাথে জিআই পণ্যের দেওয়া তালিকায় এই শিল্পের নাম দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে খয়ের শিল্প রক্ষার জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করা হবে। রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান শাহ বলেন, খয়ের গাছ বৃদ্ধিতে কাজ করা হয়েছে। তার অংশ হিসেবে রাজশাহীতে একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে খায়ের গাছ লাগানো হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :