ড.নাজিব আরিফ
মেট্রোরেল বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর রাজধানী ঢাকার আধুনিক দ্রুতগামী গণপরিবহণ ব্যবস্থা। মেট্রোরেল ইতোমধ্যে স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরে খুশি যাত্রীরাও।বিশেষ করে বর্তমান প্রচণ্ড গরমে যেখানে জীবন হাস পাস অবস্থা, তারপর লক্কর ঝক্কর বাসে জীবন যেখানে আসে যায় অবস্থা সেখানে সম্পূর্ণ শীততাপনিয়ন্ত্রীত মেট্রোরেলে যাত্রীরা ফেলছে স্বস্তির নিশ্বাস। সরকার পরিকল্পনা অনুযায়ী যানজট নিরসনে মেট্রোরেলকে ঢাকা শহরে ছড়িয়ে দিতে কাজ শুরু করেছে। মেট্রোরেলের ৬ টি রুট ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মাণ করে ঢাকা শহরের যানজট মুক্ত করার জন্য কাজ করছে বর্তমান সরকার।
জাইকা ও ডিএমটিসিএল ২০৩০ সাল নাগাদ ১২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট ৬টি মেট্রো লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলছে। এই নেটওয়ার্কে ৫১টি উড়াল ও ৫৩টি ভূগর্ভস্থ স্টেশন থাকবে। ছয়টি লাইন মিলিতভাবে দিনে ৪৭ লাখ যাত্রী পরিবহণের লক্ষ্য নিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে কাজ । ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ এমআরটি লাইন ৬-এর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও অংশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মাধ্যমে ঢাকার গণপরিবহণে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে, যা ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ থেকে জনসাধারণের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।এরই ধারাবাহিকতায় ৫ নভেম্বর, ২০২৩ এমআরটি লাইন-৬ এর আগারগাও থেকে মতিঝিল অংশে যাত্রী চলাচল শুরু হয়।এমআরটি লাইন ৬ উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর যাবে।এপথে মোট ১৭টি স্টেশন রয়েছে। এগুলো হলো- উত্তরা-উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর। এর মধ্যে কমলাপুর বাদে বাকি সবগুলো স্টেশন চালু হয়েছে। কমলাপুর স্টেশনটি ২০২৫ সাল নাগাদ চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পটি ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে।
অতি জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ঢাকায় স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) তৈরি করে মেট্রোরেল নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়। উক্ত এসটিপি প্রণয়ন, অনুমোদন এবং শহরের পরিবহণ নেটওয়ার্কের জন্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিলো। এ পরিকল্পনায় ৩টি এমআরটি ও ৩ টি বিআরটি লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তী তে ২০১৩ সালে কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনার অধীনে ঢাকায় মেট্রো রেল স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালে সংশোধিত “কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রো রেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২১.২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন ৬-কে নির্বাচন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ শুরু হয়।
২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর এমআরটি-১ লাইনটির নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১.২৪ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকার দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে। এমআরটি-১ প্রকল্পে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২১ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ১১.৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। নতুন বাজার থেকে কুড়িল পর্যন্ত ৩.৬৫ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রানজিশন লাইনসহ ৩১.২৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এই মেট্রোরেলের ১২টি স্টেশন থাকবে মাটির নিচে এবং ৭টি থাকবে উড়াল সেতুর ওপর। এমআরটি লাইন-১ হবে দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল।
২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জি২জি ভিত্তিতে পিপিপি পদ্ধতিতে এমআরটি লাইন ২ নির্মাণ করা হবে। এরই মধ্যে জাপান ও বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এই রুটের স্টেশনগুলো হলো- গাবতলী, ঢাকা উদ্যান, মোহাম্মদপুর, ঝিগাটোলা, সায়েন্স ল্যাব, নিউমার্কেট, আজিমপুর, পলাশী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, গুলিস্তান, মতিঝিল, কমলাপুর, মান্দা, দক্ষিণগাঁও, দামরিপাড়া, সাইনবোর্ড, ভুইঘর, জালকুড়ি এবং নারায়ণগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থল প্রধান লাইনে এবং শাখা লাইনে গুলিস্তান, গোলাপ শাহ মাজার, নয়াবাজার ও সদরঘাট।সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী মেট্রোরেলের লাইন-২ এ পুরনো ঢাকাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এলিভেটেড এবং আন্ডারগ্রাউন্ড এর সমন্বয়ে এমআরটি লাইন -২ এর সম্ভব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকার মতো। এমআরটি লাইন -২ এর ডিপো, একসেস করিডোর এবং ইয়ার্ড নির্মাণে মাতুয়াইল এবং দামড়ি পাড়া মৌজার গ্রীণ মডেল টাউন এবং আশুলিয়া মডেল টাউনের মধ্যবর্তী স্থানে সর্বমোট ৬৫ হেক্টর জমিতে নির্মান করা হবে। এখানে উল্লেখ পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে পড়েছে দেশের প্রধান নদী বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন রুটের লঞ্চগুলো। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঐ রুটের ব্যবসাবাণিজ্য। শুধু যে পদ্মা সেতুর কারণে এমনটি হয়েছে তা কিন্তু না।রাজধানী ঢাকার যে কোনো স্থান থেকে সদরঘাট যেতে যানজটে যে পরিমাণ ভোগান্তিতে পড়তে হয় সে-তুলনায় সড়ক পথে যাত্রীদের অর্থ, সময় এবং সাচ্ছন্দ্য অনুকূলে থাকে। তবে লঞ্চ প্রেমী যাত্রীদের জন্য আবারও ফিরছে সুদিন। মেট্রোরেলের কল্যাণে পুরনো ঢাকা এবং সদরঘাট যাতায়াতে লাগতে যাচ্ছে আধুনিকতার ছোঁয়া।একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে ঢাকায় যানজটের কারণে দেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রায়২.৯ শতাংশ কমে যাচ্ছে। প্রতিদিন ট্রাপিক জ্যামের কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া কর্মঘণ্টার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। সড়ক খুঁড়া খুঁড়ি, অবৈধ ফুটপাত দখল, অপরিকল্পিত গাড়ি পার্কিং, অপ্রতুল সড়ক অবকাঠামো এবং অনিয়ন্ত্রিত ট্রাপিক জ্যামের কারণে বিশেষ করে পুরনো ঢাকায় সৃষ্ট অসহনীয় যানজটের কারণে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি উত্তোরণে মেট্রোরেল আশা দেখাচ্ছে পুরনো ঢাকার বাসিন্দাদের।
পিপিপি পদ্ধতিতে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলওয় ট্রাকের পাশ দিয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল মেট্রোরেল হিসেবে এমআরটি লাইন ৪ নির্মাণের উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন, যা শেষ হবে ২০৩০ সালের মধ্যে । এই লাইনের স্টেশনগুলো হলো কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড, কাঁচপুর ও মদনপুর।
এমআরটি লাইন-৫ নির্মাণ প্রকল্পে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ হবে। এই প্রকল্পের ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা দেবে জাপান আর বাকি ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। এতে ১৪টি স্টেশন থাকবে, যার মধ্যে ৯টি স্টেশন হবে আন্ডারগ্রাউন্ড। গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর ১, মিরপুর ১০, মিরপুর ১৪, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান ২ ও নতুন বাজারে এসব আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ করা হবে। ৫টি স্টেশন এলিভেটেড করা হবে। হেমায়েতপুর, বলিয়ারপুর, বিলমালিয়া, আমিন বাজার এবং ভাটারায় (বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়) ৫টি এলিভেটেড স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর রুট) এর সাভার উপজেলার হেমায়েতপুরে ডিপো থাকবে।
২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ১৭.৪০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। তার মধ্যে পাতাল ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং উড়াল ৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার। এটি গাবতলীকে দশেরকান্দির সাথে সংযুক্ত করবে। এই রুটের স্টেশনগুলো হলো গাবতলী, টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট, আসাদ গেট, রাসেল স্কয়ার, কারওয়ন বাজার, হাতিরঝিল, তেজগাঁও, আফতাবনগর, আফতাবনগর কেন্দ্র, আফতাবনগর পূর্ব, নাসিরাবাদ এবং সর্বশেষ দশেরকান্দি। গাবতলীতে এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর রুট) এবং এমআরটি লাইন-২ এর সাথে, কারওয়ান বাজারে এমআরটি লাইন-৬ এর সাথে interchange করা হবে।
কমলাপুর রেল স্টেশন এখন নানা কারণে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হলো পদ্মা রেলপথ উদ্বোধন এবং দেশের অত্যাধুনিক গণপরিবহন উড়াল পাতাল মেট্রোরেলের সমন্বয়ে শেষ স্টেশনগুলো নির্মাণ হচ্ছে এখানেই। এসবগুলো মেট্রোরেলের হাব হিসেবে কাজ করবে কমলাপুর। এখানে মাটির উপরে ও নিচে স্টেশন নির্মাণ করা হবে।সবমিলিয়ে দেশের পরিচিত কমলাপুর রেল স্টেশন এলাকাটি একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তেমনি এ এলাকাটিও আধুনিক স্থাপনায় ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করেছে।
পিআইডি ফিচার
আপনার মতামত লিখুন :