সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বিড়ালক্ষী গ্রামের ৩৫ বছরের যুবক বাপ্পি স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ে অনলাইন জুয়ায়। এজেন্টের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলে ‘ওয়ানএক্সবে’ নামক অনলাইন বেটিং ওয়েবসাইটে নিয়মিত জুয়া খেলতে থাকে । প্রথমে কয়েকদিন লাভ হলেও পরে হারতেই থাকে। একপর্যায়ে স্ত্রীর স্বর্ণের চেইন ও আংটি বিক্রি করে জুয়ায় বিনিয়োগ করে । তাও রক্ষা হয়নি একে একে সবকিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে বাপ্পি।
ফেনীর সোনাগাজীর বাবু, পেশায় অটোচালক। টানাপড়েনের সংসার তার। এই অভাব-অনটনের মধ্যেও অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে । এক বন্ধুর পরামর্শে বাবু অনলাইন জুয়ার ৮৮ সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে শুরু করে জুয়া খেলা । শুরুতে কিছুদিন লাভ হতো আর এটা থেকেই তার আসক্তি তৈরি হয়।এরপর আয়ের চেয়ে লোকসানই বেশি হয়। এই আসক্তি থেকে চাইলেই বাবু বের হতে পারছেন না । লাভের আশায় হারাচ্ছেন অর্থ।দিনদিন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে,পরিবারে এখন অশান্তি বিরাজ করছে।
এ খবরগুলো গণমাধ্যমে এসেছে। শুধু সাতক্ষীরার বাপ্পি বা ফেনীর বাবু নয়, গণমাধ্যমের তথ্য মতে, বাংলাদেশের কম-বেশি অর্ধ কোটি মানুষ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। হাতে হাতে স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট থাকায় প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি কোমলমতি শিশুরাও জুয়ায় আসক্ত হচ্ছে। যাদের নিজস্ব স্মার্টফোন নেই, তারাও জড়িয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়ায়। সেক্ষেত্রে স্মার্টফোন ভাড়া নিয়ে জুয়ায় বিনিয়োগ করছে তারা। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপসের বিস্তার ঘটিয়ে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন জুয়ার স্থানীয় মাস্টার এজেন্ট ও সাব এজেন্টরা। এলাকার মানুষকে চুষে কোটিপতি বনে গেলেও অনলাইন জুয়ার মাস্টার এজেন্ট ও সাব এজেন্টরা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে লাখ লাখ মানুষ জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগে বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশীয় সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। অনলাইন জুয়ার বিভিন্ন অ্যাপস এবং ক্যাসিনোগুলোতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন লোকাল ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে অনলাইন জুয়া খেলা হয়। এর সাথে স্থানীয় মোবাইল ব্যাংকিং এর এজেন্টরাও জড়িত মর্মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে।
বাংলাদেশের নামিদামি সেলিব্রেটি এবং শোবিজ মডেল ও তারকারা তাদের নিজস্ব ফেসবুক পেজ এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্টে টাকার বিনিময়ে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রমোট করছে। সোশ্যাল মিড়িয়াসহ অনেক অনলাইন মিডিয়া তাদের পেজে বিভিন্ন জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার করে মানুষকে আকৃষ্ট করছে। বিশেষকরে আইপিএল, বিপিএল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপসহ জনপ্রিয় সব খেলা সম্প্রচারকালে ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে অনলাইন জুয়া বা বিভিন্ন বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন । অনলাইনে জুয়ার এসব চটকদার বিজ্ঞাপনের ফলে অধিক আয়ের আশায় ঝুঁকছে মানুষ। দিন দিন অনলাইন জুয়াড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জুয়াড়িদের সাহায্য করার জন্য রয়েছে এজেন্ট সিন্ডিকেট। তারা জুয়াড়িদের অ্যাকাউন্ট খুলে দেয় ও ডলার সরবরাহ করে ।এখানে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে রয়েছে মাস্টার এজেন্ট ও সাব এজেন্ট। এসব এজেন্টের কাছ থেকে বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময়ে ডলার সংগ্রহ করে জুয়াড়িরা।সহজে প্রচুর টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও তরুণেরা অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। বাদ যাচ্ছে না নারীরাও। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে তারা। এ কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ। জুয়ার টাকা যোগাতে কেউ কেউ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে জুয়ার ফাঁদ পাতা হয়। লোভ দেখানো হয় বিনা পরিশ্রমে ঘরে বসেই দিনে লাখ টাকা আয়ের সুবর্ণ সুযোগের। এসব জুয়ার সাইটে যুক্ত হতে প্রথমে দিতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ । সেই টাকায় ডিজিটাল কয়েন কিনে ধরতে হয় বাজি। প্রথম দিকে বাজির টাকায় যখন দুই তিন গুণ টাকা ফেরত আসে, তখন বাড়তে থাকে লোভ। যেভাবেই হোক আরো টাকা জোগাড় করে আবার ধরা হয় বাজি। কিন্তু হেরে গেলে সব টাকাই লস।তখন হারানো টাকা ফিরে পেতে আরো টাকা জোগাড় করে বিনিয়োগ করে জুয়াড়ুরা। এভাবে বাজি ধরার চক্রে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। জুয়া বা বাজি হচ্ছে এমন একটা খেলা যা লাভ বা লোকশানের মধ্যে ঝুলন্ত থাকে। একজন জুয়াড়ি ১০ বার খেলার জন্য টাকা বিনিয়োগ করলে ৬ থেকে ৭ বার জয়ী হয়। এতে জুয়াড়ির আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। এজন্য সে পরের খেলায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে থাকে। তখন আর লাভের মুখ দেখতে পায় না। সেই লোকসানের বিনিয়োগ তুলতে গিয়ে উলটো নিয়মিত বিনিয়োগ করে সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়। জুয়ায় আসক্ত মানুষের মনে জুয়া খেলার জন্য অসম্ভব এবং অনিয়ন্ত্রিত এক ধরনের চাহিদার সৃষ্টি হয়।ফলে জুয়াড়ির জন্য সেই চাহিদা পূরণ না করে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। যেকোনো কিছুর বিনিময়েই আসক্ত মানুষটি সেই চাহিদা পূরণ করতে চায় এবং জুয়া খেলতে চায়।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন এবং সংবিধান অনুযায়ী জুয়া খেলা বেআইনি এবং অপরাধ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ এর ৯২ ধারা, দণ্ডবিধির ২৯৪-এ এবং ২৯৪-বি ধারায় যে কোনো ধরনের জুয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং জুয়া খেলাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশ আমলে জুয়া নিষিদ্ধ করে একটি আইন করা হয়েছিলো। এ আইনে সাজার পরিমাণও খুব কম। অনলাইন গেম্বলিং অনলাইন বেইজ অপরাধ, যা নিয়ন্ত্রণে দেশে কোন আইন নেই। অথচ অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ ই-মানির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে। বর্তমানে অনলাইন জুয়ার মামলা করা হচ্ছে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে। কারণ, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে ই-মানি ট্রানজেকশনকে অবৈধ উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধারার অপরাধ আগে ছিল কগনিজেবল। এখন সেটি নন-কগনিজেবল করা হয়েছে। ফলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য অন লাইনে জুয়া খেলার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে সমস্যা হচ্ছে এবং জামিনযোগ্য অপরাধ হওয়ায় অপরাধীরা খুব সহজেই আদলত থেকে জামিনে বের হয়ে আবারও জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অনলাইনে জুয়া খেলার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় টুলসসহ কারিগরি ও ডিজিটাল সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে।
ডিজিটালাইজেশন এর যুগে আইন প্রয়োগ করে অনলাইন জুয়া চিরতরে বন্ধ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। কারণ কারণে এটি প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এবং এটি নিজের বাড়ি বসেই খেলা যায় তাই এখানে আইন প্রয়োগ করা কঠিন। অনলাইন জুয়া প্রতিরোধের জন্য পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার গত কয়েক বছরে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে। সিআইডি, ডিবি ও র্যাবের হাতে ধরা পড়েছে জুয়ার ওয়েবসাইট পরিচালনাকারী শতাধিক ব্যক্তি। তবে প্রতিটি সাইট বন্ধ করার পরপর এই চক্র ভিপিএন দিয়ে ওয়েবসাইটগুলো আবার সচল করে। অবৈধ হলেও জুয়ার ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় অপরাধীরা প্রতিনিয়ত কৌশল পরিবর্তন করে এটি সচল রাখছে।
অবৈধভাবে দেশে চালু অনলাইন জুয়ার বিস্তার খুব দ্রুততার সাথিই ঘটছে। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলেই খুবই উদ্বিগ্ন । দেশের জনগণকে সচেতন করতে সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন তথ্য অধিদফতর, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর,বাংলাদেশ টেলিভিশন,বাংলাদেশ বেতার,কমিউনিটি রেডিওসহ সকল গণমাধ্যম অনলাইন জুয়ার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে নিয়মিত প্রচার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকেও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছ। সে বিষয়েও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদফতরগুলো বিশেষ করে তথ্য অধিদফতর প্রয়োজনীয় প্রচার কার্যক্রম চালু রেখেছে।
অনলাইন জুয়া বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, পরিবার ও অর্থনীতির জন্য এক ভয়ংকর বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি শুধু একটি নৈতিক অবক্ষয় নয়, বরং একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে, যা মানুষকে নিঃস্ব করছে, অপরাধপ্রবণ করে তুলছে এবং বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করছে। এই সংকট থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক সচেতনতা, আইনের কঠোর প্রয়োগ, প্রযুক্তিগত নজরদারি এবং পারিবারিক ও শিক্ষাগত পরিবেশে মূল্যবোধের চর্চা। শুধু আইন দিয়ে নয়—মানসিক ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেই অনলাইন জুয়ার মতো সর্বনাশা আসক্তিকে ঠেকানো সম্ভব। এখনই সময়, সমাজ ও রাষ্ট্র একসঙ্গে এগিয়ে এসে এই অশুভ জুয়ার ফাঁদ ভেঙে একটি সুস্থ, নিরাপদ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার।
ইমদাদ ইসলাম
আপনার মতামত লিখুন :