শিক্ষিত পরিবারটিতে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা সমাজের অন্যদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা আদায় করেছিল এতকাল। পরিবারের বাবা-মা যার যার ক্ষেত্রে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। এক পুকুর বিশুদ্ধ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গোবরের মতো উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল পরিবারের একমাত্র পুত্রধন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষটি আত্মীয়-স্বজনসহ নানা জনের কাছ থেকে টাকা ধার করতে শুরু করেছে। কারণ হিসেবে বলে, সংসারের খরচ চালাতে সাহায্য দরকার। কখনো বলে মায়ের অসুখ, কখনো বাবার। একজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে আরেকজনকে শোধ করে। কয়েকজনকে শোধ করল না, তখন এই টাকা ধারের বিষয়টি কানে এল বাবা-মায়ের। ছেলে টাকা দিতে পারছে না, মানুষ ছেলের বাবার কাছে টাকা চাইতে এলেন। বাবা-মায়ের পেনশনের টাকা আছে, জমি-জমার আয় আছে, একমাত্র পুত্রের দেনা মেটানো বাবা-মায়ের জন্য সহজ বিষয় এমনটিই ভেবেছেন অন্যরা।
লজ্জিত বাবা-মা সত্যিই পুত্রের দায় মেটালেন। সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে এভাবে দায় মেটানো পরিবারটির নিয়মিত কাজে পরিণত হলো। পুত্রের কাছে জানতে চাইলে প্রযুক্তি বিষয়ে কম জানা বাবা-মা শুনলেন অনলাইন ট্রেডিং এর কথা। জানলেন অনলাইনে এক রকমের আর্থিক বাজার আছে, যেখানে বিভিন্ন বিনিয়োগকারী স্টক, ফরেক্স, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং অন্যান্য আর্থিক উপকরণ কেনাবেচা করে দ্রুত লাভ করতে পারেন। পুত্রের ধারদেনার হেতু তবে এই আর্থিক বাজারে কেনাবেচা করার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজির জোগাড়! দ্রুত লাভ করার আশায় এটা করলেও লস যে হচ্ছে! পুত্রের যুক্তি, লাভের জন্য ঝুঁকি নিতে হয়। সেই ঝুঁকির কী কোনো পরিমাপ নেই?
আসলেই নেই। অনলাইনে প্রতারণা হচ্ছে হরদম। অনেক অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম বা কোম্পানি বিনিয়োাগকারীদের বেশি লাভের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে। এই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক মানুষ তাদের সব টাকা হারিয়ে ফেলেন। পুত্র দৃঢ়কণ্ঠে জানাল, প্রতারণা টের পাওয়ার সিক্স সেন্স নাকি তার খুব প্রবল। কয়েকবার নিজেও প্রতারিত হয়েছে, সে সত্য চেপে গেল চুপচাপ। এর ফলে হলো কী? একমাত্র পুত্র বলে সন্তান¯স্নেহে অন্ধ বাবা স্ত্রীকে লুকিয়ে পুত্রের হাতে টাকা দিলেন। সিক্স সেন্সওয়ালা পুত্র কিছু দিনের মধ্যেই আবারো টাকা চেয়ে বাবাকে যুক্তি শোনায় এরকম মাঝে মাঝে লস হয় সব ব্যবসায়। ক্ষতির সম্ভাবনা মাথায় রেখে বিনিয়োগ করেন সব ব্যবসায়ী। পিতা আরও একবার বিভ্রান্ত হলেন। এর কিছুদিন পর ‘খুব লাভ হচ্ছে’ জানিয়ে আরও লাভের আশায় বিনিয়োগের ইচ্ছায় পুত্র আরও টাকা চাইতে এল। পুত্রের আত্মবিশ্বাস দেখে খুশি পিতা দিলেনও। কিন্তু কিছুদিন পর পুত্র আবারও টাকা চাইলে জানলেন, লস হয়েছে। এমনি লস, পুরো পুঁজি গেছে উবে।
বাজারের গতিবিধি এবং নিজের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনলাইন ট্রেডিং এর অনেক বিনিয়োগকারী টাকা হারায়। পুত্র কয়েকবার জিতলেও এইবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সব টাকা হারিয়েছে। তাই বলে থেমে গেলে তো চলবে না পুত্রের। দরকার আরও টাকা। পিতা বিষণ্ণ। মনের ভেতর পুত্র¯স্নেহের চেয়ে বেশি টের পাচ্ছেন উদ্বেগ। মা এতদিনে বুঝে গেছেন, কোনো এক সর্বনাশা ফাঁদে জড়িয়ে গেছে পুত্র। সেই ফাঁদে পুত্রের কারণে জড়িয়ে পড়া স্বামীকে ঠেকাতে মুখ খুললেন মা। বাধা পেয়ে গোখরো সাপের মতো ফনা তোলে পুত্র। মায়ের বিভ্রম জাগে, একেই কি পেটে ধরেছিলেন তিনি? সন্তানের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তাদের। যেমন অনলাইন ট্রেডিং-এ বিনিয়োগকারীরা তাদের ট্রেডগুলো অনলাইনে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও অনেক সময় বাজারের গতিবিধির কারণে তারা তাদের ট্রেডের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। অনেক অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম বা কোম্পানি বেশি লাভের প্রলোভন দেখায় আর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণহীন পুত্র তার মতো আরও অনেক বিনিয়োাগকারীর মতো নিজের পুঁজিকে অতিরিক্ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কার্যকলাপ থেকে পুত্রকে বিরত রাখতে বাবা-মা বোঝালেন। কাজ হচ্ছে না। অন্যদের কাছ থেকে টাকা ধার চাওয়ার পাশাপাশি এখন সেই পুত্র বাবা-মায়ের সাথে দিনরাত অশান্তি করছে টাকার জন্য। বাবা-মায়ের সারা জীবনের সঞ্চয় ক্রমশঃ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই বৃদ্ধ বয়সে সর্বস্বান্ত হওয়ার ভয় রাতের ঘুম, দিনের আরামকে দূর করে দিয়েছে বলা যায়। এই পর্যন্ত পড়ে পাঠক নিশ্চয়ই বলবেন, সাবধান থাকলেই তো অনলাইন ট্রেডিং-এর মাধ্যমে সর্বস্বান্ত হওয়া থেকে বাঁচা যায়। প্রতারণা থেকে সাবধান থাকতে অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম বা কোম্পানি নির্বাচন করার আগে তাদের নির্ভরযোগ্যতা এবং নিরাপত্তা যাচাই করে দেখতে হবে। ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বেশি লাভ করার লোভে বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ না করে বিনিয়োগের পরিমাণ সীমিত রাখতে হবে। ট্রেডিংয়ের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
এই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার শিক্ষা কি সহজে পাওয়া সম্ভব? এর জন্য দরকার অনলাইন ট্রেডিং-এ নিয়ন্ত্রণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে জানা। এর জন্য অনলাইন ট্রেডিং-এর নিয়ম-কানুন, পদ্ধতি এবং বাজারের গতিবিধির জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। এতে বিনিয়োগকারী নিজের ট্রেডগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং বাজারের ঝুঁকি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারবেন। এতক্ষণ যে পরিবারের পুত্রটির কথা বললাম, তার মতো বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত এমন অনেক ‘বোকা’ বিনিয়োগকারী আছে, যারা ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে. অনলাইন ট্রেডিং সম্বন্ধে খুব বেশি জ্ঞান না নিয়েই লোভের বশবর্তী হয়ে পুঁজির ঝুঁকি নিচ্ছে আর সত্যিকার অর্থেই সর্বস্বান্ত হচ্ছে। পত্রিকার পাতায় উঠে আসা এরকম কিছু খবর গুগল করলেই জানা যায়। যেমন ধরুন, চট্টগ্রামে অ্যাপভিত্তিক অনলাইন ট্রেডিং ‘ফরেক্স ট্রেডিং’-এর প্রতারণা। ‘ফরেক্স ট্রেডিং’-এর নামে ক্রিপটোকারেন্সির আদলে গড়ে ওঠে অ্যাপ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ বা এমটিএফই। এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে প্রতারক চক্র অন্তত এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিল কয়েক বছর আগে। চিহ্নিত কিছু জুয়াড়ি বা গেম্বলার পরিকল্পিতভাবে তরুণদের টার্গেট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করে। টিম-কমিশনের লোভে পড়ে প্রত্যেক ট্রেডার রেফার করতে থাকে কাছের মানুষদের। কয়েক হাজার মানুষ বেশি মুনাফার আশায় এই অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়।
অনলাইন দুনিয়ায় ট্রেডিং আর বেটিং প্রতারকদের কারণে মিলেমিশে গেছে। অনলাইন ট্রেডিং সৎভাবে করতে চাইছেন, কিন্তু মনের অজান্তেই লোভের শয়তান ফেলে দিতে পারে বেটিং বা জুয়ার খপ্পরে। শহরে তো বটেই, গ্রামে-গঞ্জে প্রতারণার চিত্র ক্রমশঃ দগদগে ঘায়ের রূপ নিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে সামাজিক সমস্যা। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অবৈধ ক্রিপ্টো ট্রেডিং, গেমিং, বেটিং এবং ফরেক্স বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যপক হারে বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে এসব অপরাধ হুন্ডি প্রক্রিয়াকে সহজ ও ত্বরান্বিত করছে। এর ফলে মুদ্রা পাচার বেড়ে যাচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশ প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরে এলে বিপদে পড়তে হবে, সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি আছে এসব বিষয়ে এসব তথ্য গুগল করে জেনেছেন পরিবারটির বাবা-মা। পুত্রকে অনলাইন ট্রেডিং-এর পাশাপাশি, অন্যান্য বিনিয়োগ বিকল্প যেমন মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড, এবং রিয়েল এস্টেট-এর মতো বিকল্পগুলো বিবেচনা করতে উদ্বুদ্ধ করছেন। দেখা যাক, পুত্রের মতি ফেরে কী না!
নাসরীন মুস্তাফা
আপনার মতামত লিখুন :