বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়ায় সেউজগাড়িতে রথযাত্রা বের করার সময় বিদ্যুৎস্পর্শে পাঁচজনের মৃত্যু হলেও এ সংখ্যা এখন ছয়জনে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত আরও ৪০ জন। এরমধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে আয়োজক কমিটির ভুলে বগুড়ার রথযাত্রায় হতাহতের ঘটনা বলে অভিযোগ করেছেন বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) পি এম ইমরুল কায়েসকে প্রধান করে পাঁচ সদস্য কমিটি করা হয়েছে। কমিটি দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং বিদ্যুৎ বিভাগ ও পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বছরে দুই দফা রথযাত্রা ও উল্টোরথযাত্রা বের হয়। শহরের রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের অবস্থান অনুযায়ী ঠিক কত ফুট উচ্চতায় রথ ওঠানো যাবে, তা আয়োজকদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের সেই সতর্কতা সত্ত্বেও ২৫ ফুট উচ্চতায় রথের চূড়া ওঠানো হয়। রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর দায়িত্ব ছিল একজনের হাতে। কিন্তু তার ভুলেই ঘটে গেল মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা।’
প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, বগুড়ার সেউজগাড়ীতে আনন্দ আশ্রমের ইসকনের রথটির সামনের অংশ দেখতে মিনি ট্রাকের মত ছিল। ১২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট চওড়া লোহার তৈরি জগন্নাথের এই রথটি। এই রথে লোহার চূড়া ছিল আরও ২০ ফুট। যা ছিল সোনালি রঙ করা। এতে স্টিয়ারিং আছে এবং কাঠ ও লোহা দিয়ে তৈরি চাকা। রথের হাইড্রেলিক ব্রেকও আছে। গোবিন্দ চন্দ্র সেন নামে একজন চালক রথটির স্টিয়ারিং দিয়ে রথের নিয়ন্ত্রণ করেন।
ইসকন মন্দিরের অধ্যক্ষ খরাজিতা কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারি রথে বসে রথটি পরিচালনা করছিলেন। হাজার হাজার ভক্ত সেউজগাড়ী দুর্গা মন্দিরের সামনে থেকে টেনে টেনে রথটি নিয়ে যাওয়া শুরু করেন। রথের মধ্যে ছিল শতাধিক ভক্ত। সেখান থেকে দেড়শ’ গজ দূরে রথটি যখন আমতলা তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছে তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। ২০ ফুট লম্বা রথের লোহার চূড়ার সাথে সড়কের ওপর দিয়ে যাওয়া উচ্চ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লাগে। এতে আগুন ধরে যায়। আগুনে ঝলসে যায় শিশু ও নারীসহ ৩৮জন।
রথযাত্রা উৎসব আয়োজক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক অধ্যক্ষ খরাজিতা কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘রথযাত্রার সবকিছু দেখভাল করতে কমিটির পক্ষ থেকে ১০০ জন সেবক নিয়োগ ছিল। সড়কের ওপর বৈদ্যুতিক তারে যেন রথের স্পর্শ না লাগে, এ জন্য রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর জন্য দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া ছিল। আমতলা মোড়ে ভুলক্রমে রথের চূড়া নিচে নামানোর আগেই বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লেগে আগুন ধরে যায়। রথে হাত রাখা সবাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘চূড়া ওঠানো-নামানোর দায়িত্বে থাকা অলোক কুমার ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। সুশান্ত দাসের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
রবিবার (৭ জুলাই) বিকেল সোয়া ৫টার দিকে বগুড়ার ইসকন মন্দির থেকে রথযাত্রা বের হওয়ার পর ১০০ গজ দূরে বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি আমতলা মোড় এলাকায় এ দুঘটনা ঘটে। এতে ৫জনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- শিবগঞ্জ উপজেলার আটমুল ইউনিয়নের কুলুপাড়া গ্রামের মৃত নরেন্দ্র কুমারের ছেলে অলক কুমার সরকার (৪২)(তিনি রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর দায়িত্বে ছিলেন), বগুড়ার সদর উপজেলার তিনমাথা রেলগেটের লঙ্কেশ্বরের স্ত্রী আতসী রানী (৪০), শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল গ্রামের মৃত সুদেবের মেয়ে শ্রীমতি রঞ্জিতা মোহন্ত (৬০), আদমদীঘি উপজেলার কুন্ডু গ্রামের মৃত ভবানী মহন্তের ছেলে নরেশ মহন্ত (৬০) ও সারিয়াকান্দি উপজেলার সাহাপাড়ার বাসুদেব সাহার স্ত্রী জলি সাহা (৩০)। এ ছাড়া আরও এক অজ্ঞাত নারীর মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, রথযাত্রা বের হয়ে সেউজগাড়ী আমতলা এলাকায় পৌঁছালে রথের চূড়াটি সড়কের ওপর দিয়ে যাওয়া উচ্চ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে আসে। এতে আগুন ধরে যায়। এ সময় রথের ওপরে বসে থাকা এবং নিচে থাকা বহু লোক আহত হন। তাদের উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পাঁচজনকে মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে মুত্যু সংখ্যায় একজন বেড়ে ছয়জনে দাড়ায়।
মেডিক্যাল ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আনিস এ ঘটনায় ৩৭ জন আহত হয়ে শহীদ জিয়াউর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি আছেন বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ভর্তি আছেন আরও ৩ জন। বিদ্যুস্পর্শে সৃষ্ট আগুনে অনেকের শরীর ঝলসে গেছে। বলে হাসপাতালটির আরএমও শফিক আমিন কাজল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) নির্বাহী প্রকৌশলী (১) আব্দুল মান্নাফ জানিয়েছেন, বিকেল সোয়া ৫টার দিকে রথের গাড়িতে বিদ্যুৎ স্পর্শের ঘটনার খবর পাওয়ার পর পরই স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল।
রথযাত্রায় মর্মান্তিক ঘটনার পর বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম নিহতদের সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে এবং আহতদের সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এছাড়াও আহতদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাদেরকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া হবে। তিনি নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
এ ঘটনার নিহত ও আহতদের স্বজনদের সমবেদনা ও সান্ত্বনা জানাতে বগুড়া ৬ আসনের সাংসদ রাগেবুল আহসান রিপু, বগুড়ার পুলিশ সুপার (পদোন্নতি প্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শুভাশিষ পোদ্দার লিটন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজা পারভীন, পৌর প্যানেল মেয়র পরিমল চন্দ্র দাস। এছাড়াও এ দূর্ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বগুড়া-৫ আসনের সাংসদ আলহাজ্ব মজিবর রহমান মজনু, জেলা আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন, জেলা পুুজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সাগর কুমার রায়, সাধারণ সম্পাদক নির্মল রায়, শহর পূজা উদযাপনের সভাপতি পরিমল প্রসাদ রাজ শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :