সুমাইয়া সুলতানা হ্যাপি: মাদক সেবনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে আটকিয়ে ভয়ভীতি দেখাতে গিয়েই উত্তেজিত হয়ে বন্ধু তপু হোসেনকে (১৪) হত্যা করেছে জয়নাল আবেদিন জয় ও ঈশা খালাশি। গ্রেপ্তারের পর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে এই হত্যার কথা স্বীকার করেছে দুই বন্ধু।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) ঈশ্বরদী থানা ও পাবনা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে গ্রেপ্তারকৃত দুই আসামীর জবানবন্দী ও স্বীকারোক্তি নিয়ে পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মাসুদ আলম গণমাধ্যমকর্মীদের নিকট এ তথ্য জানান।
এ ঘটনা নিয়ে ঈশ্বরদী থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, হত্যাকারীরা তপুকে প্রথমে জিম্মি করে পরিবারের নিকট থেকে অর্থ আদায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু তপু জোরাজুরি করায় তাকে হত্যা করেছে বলে গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে স্বীকার করেছে। পুলিশ জানায়, চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের পর তদন্ত করে হত্যায় তিনজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও পলাতক আসামী সোহেলকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার জয়নাল আবেদিন জয় পাবনার আতাইকুলা থানার দুবলিয়া এলাকার জিয়াউর রহমানের ছেলে। সে ঈশ্বরদী সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র এবং মশুড়িয়া পাড়ার অরণ্য ছাত্রাবাসের ৩০৫ নং রুমে থাকতো। এছাড়াও জয়ের নামে আতাইকুলা থানায় একটি হত্যা মামলা আছে। অপরজন ঈশা খালাশি ঈশ্বরদীর মশুড়িয়া পাড়ার রাজন খালাশির ছেলে। ঈশা নিহত তপুর বন্ধু এবং ঘনিষ্ট প্রতিবেশী। তপু হত্যায় জড়িত পলাতক মোঃ সোহেল রাজশাহীর বাঘার চক রাজাপুর এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে। সেও অরণ্য ছাত্রাবাসে থাকতো এবং ঈশ্বরদী সরকারি কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র। নিহত তপু হোসেন ঈশ্বরদীর মশুড়িয়া পাড়ার মোঃ আবুল কাশেম প্রামানিকের ছেলে। সে ঈশ্বরদী শহরের বকুলের মোড়ের একটি লেদ কারখানায় কাজ করতো। উল্লেখ্য তপুকে অপহরণের সাতদিন পর গত শনিবার (২২ জুন) রাত ১২টার দিকে ঈশ্বরদী সরকারী কলেজের পেছনে মশুরিয়াপাড়ার অরণ্য ছাত্রাবাসের তিন তলার ৩০৫ নং কক্ষের ট্রাঙ্ক থেকে তার অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে রাজশাহী ক্রাইমসিন ডিপার্টমেন্টের একটি বিশেষ দল। গত ১৫ জুন দুপুরের পর কিশোর তপু হোসেন নিখোঁজ হয়। তপুর লাশ উদ্ধারের পর তার বাবা আবুল কাশেম প্রামানিক বাদী হয়ে ঈশ্বরদী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। স্থানীয় সূত্র ও তপুর বন্ধুদের সূত্রে জানা যায়, নিহত তপু হোসেন ও ঈশা খালাশি দুইজন বন্ধু। তারা এক সঙ্গেই চলাফেরা করতো। অরণ্য ছাত্রাবাস তাদের এলাকায় হওয়ায় সোহেলের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। এই সোহেলের মাধ্যমে পরে জয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে এরা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে ঘটনার কয়েকদিন আগে ওই ছাত্রাবাসে থাকা আরেক ছাত্র মনিরুজ্জামানের মোবাইল ফোন চুরি করে জয়। চুরি করা এই ফোন দিয়েই ঘটনার দিন (১৫ জুন) বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তপুকে অরণ্য ছাত্রাবাসের নিজের কক্ষে ডাকে জয়। তপু তখন জয়ের কক্ষে গিয়ে দুজনে মিলে মাদক সেবন করে। এরই মধ্যে সোহেল ও ঈশা খালাশি ওই কক্ষে প্রবেশ করে দরজা আটকিয়ে দেয়। মাদক নিয়ে তপুকে তারা দুতিনজন মিলে মারধর করলে তপু চিৎকার করার চেষ্টা করলে সোহেল পেছন থেকে তপুর মুখ চেপে ধরে। আর ঈশা খালাশি ওই কক্ষে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে তপুর বুকে আঘাত করে। পরে জয়ের প্যান্টের বেল্ট দিয়ে তপুর হাত-পা বেঁধে বস্তার মধ্যে ভরে রেখে ঈশা খালাশি নিজের বাড়ি থেকে একটি টিনের ট্রাঙ্ক ও পলিথিন নিয়ে এসে নিহত তপুর মরদেহটি ট্রাঙ্কের মধ্যে ভরে রাখে। ট্রাঙ্কে লাশ রেখে ঘটনার দিন থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত সোহেল ওই রুমেই থাকে এবং ঈদের পরের দিন দিন বাড়ি চলে যায়। এদিকে জয় সুকৌশলে হত্যাকান্ডের ঘটনাকে অপহরণ বলে চালানোর জন্য অপর ছাত্রের চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন থেকে তপুর বাবা আবুল কাশেমের নিকট থেকে মুক্তিপন হিসেবে বিকাশে ৩০ হাজার টাকা দাবী করে।
ছেলের বিপদের কথা ভেবে বাবা আবুল কাশেম ওই নম্বরে খরচসহ ৭ হাজার টাকা পাঠায়। এরপরই ফোন নম্বরটি বন্ধ করে দেয়। ইদের ছুটির পর শিক্ষার্থীরা অরণ্য ছাত্রাবাসে ফিরে আসে। অরণ্য ছাত্রাবাসের ৩০৪ নং কক্ষের পাশের ৩০৫ নং কক্ষ থেকে বের হওয়া দুর্গন্ধ ও রক্ত দেখে ছাত্রাবাসের মালিককে খবর দেন। তারা বিষয়টি থানায় জানালে পুলিশ ওই ছাত্রাবাসে গিয়ে তালা ভেঙ্গে কক্ষের ট্রাঙ্কের ভেত থেকে তপুর অর্ধগলিত মরদেহ সিআইডি’র সহায়তায় উদ্ধার করে।
আপনার মতামত লিখুন :